জীবন ও বাস্তবতা.
শিকারী ঈগলের মত আমার সমস্ত দেহ টানটান হয়ে উঠলো। সামনে সংকীর্ণ দূরত্বকেও সুবিশাল সাহারা মরুভূমি মনে হতে লাগলো। আমি কি পারবো? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার তাকালাম। উঁহু। পারতে হবে। সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড় শুরু করলাম। কপাল থেকে কয়েকফোঁটা ঘাম ছুটে এসে মাটিতে পড়লো এবং ধূলো ভিজিয়ে জমাট করে দিলো। শেষ মুহূর্তে যখনই ধরে নিয়েছি পারবোনা, তখনই সশব্দে আঘাত করলাম। লোকাল বাসটি থামলো। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বাসে উঠে এলাম। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে আমার এই কঠিন পরিশ্রমের কোনো সমীহ পেলাম না। কী আশ্চর্য। কেউই আমাকে বাহবা দিচ্ছেনা। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। অন্তত কেউ তো আমার পিঠ চাপড়ে দেয়া উচিত। শেষের দিকে একটা খালি সিট পেলাম। বসে পড়লাম।
এভাবেই শুরু হয় আমার মধ্যবিত্ত জীবনের দৈনন্দিন যাত্রা। বাসের তীব্র গরমে বমি ছুটে আসলেও আমার কিছু করার নেই। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া সম্ভব নয় আপাতত। ভাবছেন গাড়ি কেনার টাকা নেই আমার? অনেক টাকা আছে। টাকা পয়সা নিয়ে আমি ভাবিনা। চাইলে এখনই গাড়ি কিনে আপনাকে দেখিয়ে দেবো। হুঁ। কিন্তু, কিন্তু…… মিথ্যা বললাম। দুঃখিত। আসলে আমার টাকা নেই। গাড়ি দূরের কথা, সামান্য একটা খেলনা কিনার মত সামর্থ্যও নেই আমার। টাকা পয়সাকে সত্যিই মূল্যায়ন করি আমি। পকেট থেকে শীর্ণ মোবাইলটা বের করলাম। পাশে বসা ছেলেটা মুখ কোঁচকালো। লজ্জায় আমি মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। এই মোবাইল নিয়ে আধুনিক সমাজে নিজেকে অবাঞ্চিত পাতিহাঁস মনে হচ্ছিলো। চোখ ফেটে জল এলো লজ্জায়। কিন্তু কষ্টে কান্না আড়াল করলাম। ছেলেটাকে বললাম, “ভাইয়া, আইফোনটা বাসায় রেখে এসেছি।” আইফোনের অপ্রাসঙ্গিক উত্থাপনে ছেলেটা বিস্মিত হল। মুখ কঠিন করে বললো, “তো, আমি কি করবো?” কি করবে মানে! আবারও নিজেকে অপমানিত মনে হল। ছেলেটা বিস্মিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিলাম সে ভাববে আমি কত্ত বড়লোক! অজস্র টাকা পয়সা আমার। আর সে কিনা পাত্তাই দিচ্ছেনা! ষাট হাজার টাকা কি এতই কম! দশ টাকার কয়টা নোট মিলে ষাট হাজার টাকা হয় সেই আইডিয়া আছে গাধাটার? আচ্ছা আমি যে মিথ্যা বলেছি ছেলেটা কি বুঝতে পেরেছে? আমি কি এখন ওকে আল্লার কিরা কেটে বলবো যে সত্যিই আমার আইফোন আছে? আমি প্রচন্ড লজ্জায় আবার এবং বারবার মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। কান্নায় চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ছেলেটা আমার শার্টের ছিঁড়া হাতার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনোরকমে কষ্ট চেপে বলেছি, “কিছুক্ষণ আগেই রিকশা থেকে নামতে ছিঁড়েছে।” সে বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না। হঠাৎ গাল শক্ত করে বললাম, “আপনার কি মনে হয়? ছেঁড়া শার্ট পরে ঘুরি আমি?” আমার কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেটা চমকে গেলেও আবার স্বাভাবিক হল। আমার চেয়ে দ্বিগুণ কঠিন স্বরে চিৎকার করলো, “কেন এত বিরক্ত করছিস তুই? তোর সাথে একটা কথা বলেছি আমি? আইফোনের কথা আসলো কেন? তুই চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে দামী নতুন শার্ট পরে থাক। আমাকে শুনাচ্ছিস কেন? যত্তসব ফালতু ছেলে!” পুরো বাসের লোকজন আমার দিকে ঘুরে তাকালো। আমি অপমানে একরকম কান্নাজড়িত কণ্ঠে চিৎকার শুরু করলাম। ঐ দাম্ভিক ছেলের প্রত্যেকটা কথা আমার গায়ে বিষের মত বিঁধলো। মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন হয়। আমাকে সবাই একরকম ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিলো।
আকাশের মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসছে। ভালোই হয়েছে। আমার কান্নাটা বোঝা যাচ্ছেনা। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। ঐ জন্তুটার গালে কষে চড় দেয়া উচিত ছিলো। আমারই ভুল। ঐ ভিখারিটাকে আইফোনের কথা শোনানো উচিত হয়নি। নিশ্চয় হিংসা করেই এমন খারাপ আচরণ করেছে। নির্ঘাত হিংসা। নইলে আইফোন আর দামী শার্টের কথা শুনে অমন করবে কেন? হতচ্ছাড়াটা জীবনে চোখে দেখেছে এসব? আমার অনেক টাকা। লক্ষ লক্ষ টাকা আমার। আমার লক্ষ লক্ষ টাকা। আবারও কণ্ঠ ধরে আসছে। আঁটকে রাখছি। কোত্থেকে যে এত্ত হতাশা আসে। ব্যর্থ সান্ত্বনা পেয়ে নিজেকেও দূর্বল মনে হচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটা বাসে উঠে পড়লাম। glyburide metformin 2.5 five00mg tabs
কোনোরকম পর্যবেক্ষণ এবং নতুন ঝামেলা বাদ দিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছলাম। চারটাকা ভাড়া। পাঁচটাকার একটা নোট দিতেই সে একটাকা ফেরত দিলোনা। আমি একটাকা চাইবো? লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে চেয়ে বসলাম। বিশ্বাস করুন। প্রচন্ড লজ্জা পাচ্ছিলাম। নিজের আত্মসম্মানকে গলা টিপে হত্যা করলাম। সে এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি একটা ভিখিরি। তারপর নির্লিপ্ত গলায় বললো, “এক টাকা নাই।” টাকা নাই মানে? আমি ভেঙে পড়তে শুরু করলাম। একটাকা নেই? আজও একটাকা বাড়তি দিতে হবে? একটাকা করে এভাবে লক্ষ টাকা বাড়তি দিয়েছি এই পর্যন্ত। হাসছেন কেন? আচ্ছা লক্ষ না হোক কয়েক হাজার তো হবে? আ…… আচ্ছা, অ…… অন্তত কয়েকশ’ টাকা তো হবেই। তাই বলুন। কয়েকশ টাকা! অনেক টাকা! অনেক! আমার দম আঁটকে এলো। হেল্পারের শার্টের কোণা চেপে ধরলাম। মাথা নিচু করে বললাম, “দয়া করে আমাকে একটা টাকা ফেরত দিন। আমাকে দয়া করুন। একটা টাকাও আমার জন্য মহা সম্পদ। আমি পারবোনা এই টাকার শোক ভুলতে। আমি কিছুতেই পারবোনা। দয়া করে যেভাবেই হোক ফেরত দিন।” কিন্তু, কিন্তু এসব নিছকই কল্পনা। নিজেকে দরিদ্র প্রমাণ করলে আমার চলবেনা। আমার মান মর্যাদা আছে না? একরকম ড্যাম কেয়ার ভাব ধরে হেল্পারকে বললাম, একটাকা লাগবেনা…… যেন, যেন আমি চাইলে একটাকার যায়গায় দশটাকাও বাড়তি দিতে পারি। দশ টাকা! হেল্পারের চোখে সমীহ দেখছি, কৃতজ্ঞতা দেখছি। কিন্তু জানেন? এই একটাকার মায়া ছাড়তে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো কষ্টে। আমার পুরো মুখে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে গেল। ছুটে গিয়ে বাস থেকে নেমে হাঁপাতে লাগলাম।
প্রত্যহ এই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি মিলেনা আমার। নিজেকে অসহায় মনে হয়। শহরের সব লোক যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার জীর্ণ পোশাকের দিকে তাকায়। ইচ্ছা করে অন্তত একদিন দামী পোশাক পরে বিশ্বকে দেখিয়ে দিই। অবশ্য, কি আর বলবো। একবার দীর্ঘ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে একটা হাজারটাকার দামী শার্ট কিনেছিলাম। টাটকা শার্টের ঘ্রাণে আমার কী যে আনন্দ হচ্ছিলো। দামী শার্টের প্যাকেটটা দুলিয়ে দুলিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে আসছিলাম নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছিলো। ইচ্ছে করেই আরো বেশি ঝাঁকাচ্ছিলাম প্যাকেটটা। কিন্তু কেউই আলাদাভাবে আমার প্যাকেটের দিকে তাকালোও না। কী আশ্চর্য! কেউ তো এসে জিজ্ঞেস করা উচিত শার্টের দাম কত। আমি অহংকার নিয়ে দাম বলবো। কেউই দেখছেনা, কেউই তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত! আমি ধৈর্যহীন হয়ে উঠলাম। কেন কেউ চাইবেনা? চাওয়া উচিত। ওরা বাধ্য। রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কেউ যদি না-ই বা তাকালো এই শার্টের দিকে কিনে কি লাভটা হল? এতগুলো টাকার শার্ট! তখনই টাকার ব্যাপারটা মনে এলো। আমি চমকে উঠলাম। একরকম রুদ্ধশ্বাসে ফিরে গেলাম দোকানে। কাঁপাকাঁপা গলায় শার্টটা ফেরত দেবো বললাম। ওরা ফেরত নিতে চাইলোনা। আমি প্রায় জোর করে ফেরত দিলাম। প্রচন্ড বিরক্ত হল তারা। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অসহায়- নীচ- হীন মনে হচ্ছিলো। অথচ, কিছুক্ষণ আগেই শার্ট কেনার সময় এরা আমাকে স্যার স্যার বলে ডাকছিলো! কত্তবড় স্পর্ধা! আমাকে কি গরীব ভাবছে জানোয়ারগুলো? টাকা ফেরত নেয়ার সময় চিৎকার করে বললাম, “বাসায় গিয়ে দেখি তিনটা দামী শার্ট বাবা কিনে এনেছেন।” দামী শব্দটার উপর অনাবশ্যক জোর দিলাম। এই অকপট মিথ্যেটাও ওদের ভাবান্তর করলোনা। আমি ভেবেছিলাম ওরা আবার আমাকে সমীহ করবে। ভাববে আমি কত্ত বড়লোক! উফফ। অপমানিত মুখে নত মস্তকে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। কান্নায় চোখ ফেটে যাচ্ছিলো আবারও।
ঘরে তুলনামূলক বেশি দামী আসবাব পত্র সামনের ড্রয়িং রুমে এনে রেখেছিলাম আমি। যদিও অন্য রুম গুলো প্রায় শূন্য হয়ে গেল আসবাবের অভাবে কিন্তু তাতে কি? অন্তত তাতে যদি মান সম্মান বাঁচানো যায়। ফ্রিজ টিভি এবং একটা হোম থিয়েটার। আহা! কত্ত দামী জিনিস। সেই সাথে শোকেইস। শো কেইস ভর্তি সিরামিকের বাসন। সোফা আছে রুমে। মাথার উপর পাক্কা সাড়ে তিন হাজার টাকায় কেনা ফ্যান। ব্যাস। আভিজাত্যের জন্য আর কি লাগে? কিন্তু ভিতরের রুমে কি আছে প্লিজ জিজ্ঞেস করবেন না। আমার ভিতরের রুম দুটোতে বহিরাগতের প্রবেশ নিষিদ্ধ। একবার কি হয়েছিলো জানেন? এক আত্মীয় আসলো। খুব স্নেহ করতেন আমাকে। তাঁকে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসিয়ে আপ্যায়ন করলাম। বারবার ফ্যানের দিকে তাকাচ্ছিলাম। টিভির ব্রান্ডের নেইমপ্লেটটা বারবার মুছে দিচ্ছিলাম। যাতে তিনি দেখেন। যাতে তিনি বুঝতে পারেন কতটা অভিজাত আমরা। অকারণে ফ্রিজের ডালা খুলে বন্ধ করছিলাম। হোম থিয়েটার চালিয়ে দিলাম। আবার বন্ধ করে দিলাম। বিদ্যুৎবিল বাঁচাতে হবে। কিন্তু অন্তত তাঁর চোখে প্রমাণ করে দিয়েছি যে আমি- আমরা কত্ত বড়লোক। কিন্তু ঐ নির্লজ্জ লোকটা এবার বাড়ির ভিতরে দেখতে চাইলো। কতটা নির্লজ্জ ভাবুন তো। দিব্যি তো এই রুমে শান্তিতে আছে। ভিতরে যাবে কেন? আমি বাধা দিলাম। কঠিন চোখে বললাম, “নাহ ভিতরে যাওয়া যাবেনা।” সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বোধহয় আমার কাঠিন্যে কষ্ট পেল। পেলে পাক। আমার কি? নিজের আভিজাত্য প্রমাণে এত্ত পরিশ্রম করেছি সব তো আর এত সহজে জলে বিসর্জন দিতে পারিনা আমি। কিছুক্ষণ বসেই তিনি উঠে চলে গেলেন। বলা বাহুল্য, তিনি আর কখনোই আমাদের বাসায় আসেননি।
আসলে এসবের মানে হয়না। মানেই হয়না। টাকা পয়সা বড় ব্যাপার নয়। গর্বিত মধ্যবিত্ত হিসেবে মান সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি এই কম কি? অর্থ আভিজাত্য আমার পছন্দ নয়। কোনোদিন নিজেকে অভিজাত প্রমাণের চেষ্টা করিনি। ওহ, দুঃখিত। আবার ধরা খেলাম। সত্যিই লজ্জা পাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে সব গোমর তো ফাঁস করে দিলাম! আসলে আমার দিনের শুরুটাই হয় নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করা দিয়ে। গায়ে কম টাকায় কেনা একটা পারফিউম থেকে শুরু করে, ইস্ত্রি করা শার্ট, এমনকি রাস্তায় ভাব মেরে চলা। সমস্ত কিছুতেই আমি আসলে……… আমি…… এমনকি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে লেগে থাকে আভিজাত্য। এ যেন একটা জুয়া খেলা। এ যেন নেশা, প্রচন্ড শক্তিশালী হিরোইন বা অন্য কিছু? চাইলেও ছাড়তে পারবোনা। কিভাবে পারবো বলুন। আমি…… আমি…… আমি আসলেই অনেক……… জানিনে।
আচ্ছা এতকিছু আপনাদের কেন বলছি? ভুলে যান। বাস থেকে নেমে এসেছি। এক টাকার মায়া ছেড়েছি। আরো…… আরো এত্তকিছু করেছি। এত্তকিছু বলেছি। এরপরও আপনারা প্রমাণ চাচ্ছেন? আমি দেবোনা প্রমাণ। আমি বাধ্য নই। আমার সব আছে। আমার কি নেই? এখন আমাকে ছাড়ুন। জাহান্নামে যান বা যেখানে খুশি যান। অন্তত শান্তি দিন আমাকে। আমাকে শান্তি দিন। কি হল? আমার জুতোর দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? বর্ষাকাল তো। তাই দামী জুতোটা পরে বাইরে আসিনি। পাক্কা দুই জোড়া ব্র্যান্ডের জুতো আছে বাসায়। মাথার উপর একটি হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। দেখবেন, একদিন ঐরকম একটা কপ্টার আমি কিনে নিবো.
This user is on the @buildawhale blacklist for one or more of the following reasons: