পুষ্কর হ্রদ : যেখানে নিজেকে কুমির দিয়ে খাওয়ানো পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হতোsteemCreated with Sketch.

in আমার বাংলা ব্লগlast year


Copyright free image Source: wikimedia commons


পুষ্কর তীর্থ শব্দটির সাথে হিন্দুদের একটা নাড়ির টান আছে । কথিত আছে পুষ্কর সরোবরে একবার স্নানে যত পুন্য সঞ্চয় হয় সহস্রবার গঙ্গাস্নানেও ততোধিক নয় । হিন্দুরা বিশ্বাস করে তাদের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নিজস্ব সরোবর হলো এই পুষ্কর সরোবর । ভারতের সর্ববৃহৎ ব্রহ্মা মন্দিরটিও পুষ্কর হ্রদের তীরেই অবস্থিত । এছাড়াও সমগ্র সরোবরকে ঘিরে পাঁচশোরও অধিক হিন্দু মন্দির গড়ে উঠেছে । হিন্দু পুরাণে পুষ্কর তীর্থকে "তীর্থগুরু" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।

রাজস্থানের আরাবল্লী পর্বতমালা দিয়ে পরিবেষ্ঠিত পুষ্কর সরোবর । লুনি নদীর সাথে এর সংযোগ রয়েছে । প্রায় ২২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে বিশাল এই হ্রদটি । হ্রদটির জলের গভীরতা সব জায়গায় সমান নয় । কোথাও কোথাও ৩০ ফুট গভীরতা তো কোথাও কোথাও মোটে ৪ ফুট গভীরতা । তবে, সব মিলিয়ে হ্রদের জলের গড় গভীরতা ২০-২৪ ফুট ।

এই হ্রদটি কিন্তু একটি কৃত্রিম হ্রদ । প্রাচীন পুঁথি ঘেঁটে ও ঐতিহাসিকদের লিখিত বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে হ্রদটি হিন্দুদের পবিত্র একটি তীর্থস্থান হিসেবে মান্যতা পেয়ে আসছে । অর্থাৎ, যীশু খ্রীষ্টের জন্মেরও বহু পূর্ব থেকেই হ্রদে তীর্থযাত্রীদের আগমন স্থল হয়ে আসছে ।

হিন্দু মাইথোলজিতে বর্ণিত আছে যে একদা এক মহাশক্তিধর দৈত্য বজ্রনাভ শয়তানি করে ব্রহ্মার সেরা সৃষ্টি অর্থাৎ মানবজাতির বিনাশে প্রবৃত্ত হয় । তখন সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের এই চরম হেনস্থা সইতে না পেরে ব্রহ্মা তার হস্তস্থিত পদ্মফুলের পাঁপড়ি ছুঁড়ে দৈত্যকে বিনাশ করেন । সেই পদ্মফুলের তিনটি পাঁপড়ি ভূমিতে পতিত হয়ে সৃষ্টি হয় পুষ্কর সরোবরের । রামায়ণ ও মহাভারতেও পুষ্কর সরোবরকে আদি বা প্রথম তীর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এই জন্যই এই হ্রদ এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দুদের কাছে ।

মুঘল আমলের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে পুষ্কর হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলে ঘন বনাঞ্চল ছিল পূর্বে । সেই বনে শিকারে এসেছেন আকবর, জাহাঙ্গীর থেকে আওরঙ্গজেব সবাই । তবে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরই সর্বপ্রথম পুষ্কর হ্রদের তীরে শিকার গৃহ নির্মাণ করেন এবং প্রচুর মন্দির ধ্বংস করেন । আর আওরঙ্গজেব হ্রদের তীরবর্তী প্রায় সব মন্দিরগুলো ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ।

মুঘল ইতিহাস এবং পরবর্তীতে ইংরেজদের ভারতবর্ষ দখল করার পরের ইতিহাস থেকে এই তথ্য পাওয়া যায় যে ধর্ম মানুষকে কতটা অন্ধ করে দিতে পারে । প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশী থেকে পুষ্কর তীর্থস্নান শুরু হয় এবং শেষ হয় কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে । এই সময় লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীদের জমায়েত হয় । মুঘল ও ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে তখনকার সময়ে শাসনকর্তাদের কাছে একটা বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল অজস্র মানুষের জীবনহানি । কারণ, পুষ্কর হ্রদে তখন অজস্র বিশালকায় হিংস্র নরখাদক কুমিরে পূর্ণ ছিল । প্রত্যেক বছর পুষ্কর মেলায় ৫০০-১০০০ অব্দি তীর্থযাত্রীরা খাদ্যে পরিণত হতো এইসব নরখাদক কুমিরের ।

মুঘল সম্রাটরা অনেক কুমির হত্যা করেও এর সুরাহা করতে পারেননি । বরঞ্চ স্থানীয় জনগণ ও পুণ্যার্থীদের রোষের কারণ হয়েছিলেন তাঁরা পবিত্র কুমিরদের হত্যার কারণে । পুণ্যার্থীরা হ্রদের কুমিরদের পবিত্র কুমির হিসেবে ভক্তি করতো । প্রত্যেক বছর পুষ্কর তীর্থমেলায় পুণ্যস্নানের সময় হ্রদের ৫২টি ঘাটেই প্রচুর পুণ্যার্থীদের ভিড় হতো । আর সেই স্নানরত ভিড়ের মধ্যে থেকে মানুষ টেনে নিয়ে যেত কুমিরে । তারপরেও পুণ্যার্থীরা ভয় পাওয়ার তো দূরের কথা কুমিরে খাওয়াকে পুন্য মনে করতো । কত পুণ্যার্থী নিজের বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী বা সন্তানদের কুমিরের মুখে ছুঁড়ে দিতো, কতজন নিজেকেই উৎসর্গ করতো কুমিরের কাছে - শুধুমাত্র পুণ্যের লোভে । পুণ্যলোভাতুর তীর্থযাত্রী ধর্মের মোহে অন্ধ হয়ে যেত ।

এই সব দৃশ্য ইংরেজদের ব্যথিত করে তুলেছিল । তারা অনেক বছর ধরে বহু চেষ্টার পরে পুষ্কর হ্রদকে কুমির শূন্য করতে পেরেছিলো । আমি শুধু একটা কথাই ভাবি - ধর্ম তো মানুষের মঙ্গলের জন্যই, মানুষের জন্য ধর্ম । ধর্মন্ধতা সেই মানুষকেই অমানুষ করে তুলতে পারে ।


------- ধন্যবাদ -------


পরিশিষ্ট


এই পোস্টটি যদি ভালো লেগে থাকে তো যে কোনো এমাউন্ট এর টিপস আনন্দের সহিত গ্রহণীয়

Account QR Code

TTXKunVJb12nkBRwPBq2PZ9787ikEQDQTx (1).png


VOTE @bangla.witness as witness

witness_proxy_vote.png

OR

SET @rme as your proxy


witness_vote.png


steempro....gif

Sort:  

Very Good. It is my pleasure to get a post like this...

 last year 

ধর্মান্ধতা ব্যাপারটা বড্ড ছোঁয়াচে ব্যাধির মত , তাই জন্য আমরা এখনো পুরোদমে মানুষ হয়ে উঠতে পারছি না। পুষ্কর হ্রদ, সম্পর্কে তথ্য জেনে বেশ শিহরিত হলাম, ভাই।

This post has been upvoted by @italygame witness curation trail


If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness




CLICK HERE 👇

Come and visit Italy Community



Hi @rme,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.

Come and visit Italy Community

 last year 

পুষ্কর হ্রদ নিয়ে অনেক ইতিহাস ই আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম দাদা।সত্যি মানুষ ধর্মের প্রতি অন্ধ হয়ে কুমিরের খাবার হতে পেরেও পুন্যের কাজ মনে করতো।সত্যিই অবাক কান্ড।মানুষ যে কি?? ইচ্ছে করে ও নাকি কুমিরের কাছে নিজেকে সমর্পন করে দিতো, আহারে।জেনে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ দাদা আপনাকে শেয়ার করে জানার সুযোগ করার জন্য।

 last year 

পুষ্কর হ্রদের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে খুব ভালো লাগলো দাদা। বাপরে বাপ কি সাহস ছিলো তাদের, ভেবেই তো অবাক লাগছে। পূণ্যের আশায় কুমিরের মুখে নিজের প্রিয় মানুষদেরকে ছুঁড়ে দিতো,এমনকি নিজেকেও কুমিরের কাছে সমর্পণ করতো। আসলেই অবাক করা কান্ড। পূণ্যের আশায় মানুষ এতোটা অন্ধ হয়ে যেতো, এই পোস্টটি না পড়লে আসলেই জানা হতো না। যাইহোক এতো চমৎকার একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।

 last year 

আশা করি শ্রদ্ধেয় দাদা ভালো আছেন। আপনার পোস্টের মাধ্যমে পুষ্কর হ্রদের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে খুব ভালো লাগলো। অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম। আসলে কিছু কিছু জায়গায় ধর্মের নামে কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়েছে। যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্যিই বেশ বেমানান। কুমিরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা এটা আসলে কেমন দেখায়। পোস্টটি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে, ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দাদা।

 last year 

কতটা ধর্মান্ধ হলে এমন নৃশংস কাজ করে এটাই ভাবছি দাদা। পুণ্য হবে বলে কুমিড়ের মুখে বৃদ্ধ পিতা মাতাকেও দিয়ে দিত! শুধুমাত্র পুণ্যের আশায়। যাক,ইংরেজরা অবশেষে কুমিড় নিধন করতে পেরেছিল। তবে এই পুষ্কর হৃদ কি এখনও আছে দাদা?

 last year 

একদম ঠিক বলেছেন দাদা, ধর্ম মানুষের জন্য। তবে এই অন্ধ বিশ্বাস আসলেই কাম্য নয়।ইংরেজরা অবশেষে পুষ্কর হ্রদ কে কুমির শূন্য করতে পেরেছিল।এইটা আসলেই ভয়ানক ব্যপার পূর্ণ লাভের আশায় কুমিরের খাদ্য হওয়া।অনেক বিষয় জানতে পারলাম আপনার পোস্টটির মাধ্যমে দাদা।ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।

Posted using SteemPro Mobile

 last year 

৫০০-১০০০ প্রতি বছর তাও আবার চোখের সামনে!!! গা শিউরে উঠার মত ব্যাপার।

ধর্ম তো মানুষের মঙ্গলের জন্যই, মানুষের জন্য ধর্ম । ধর্মন্ধতা সেই মানুষকেই অমানুষ করে তুলতে পারে

মানুষের কল্যানের জন্যই ধর্ম। ধর্মান্ধতা হল সমস্যা।