বাবা, আমি কখনও বাবা হতে পারব না।। ক্রিয়েটিভ রাইটিং।।
।। নমস্কার বন্ধুরা।।
নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত
বাবা
-------------------- নীলম সামন্ত
একটি ল্যাম্পপোস্টকে বাবা হিসেবে ধরে নিলে বলতে পারি রাস্তায় কোনদিন লোডশেডিং হয়নি। কখনও কেউ ভেঙে দিয়ে গেলে আবার উঠে আলো দিয়েছে। বাবা আমাকে আঁকতে শেখায়নি। খেতে বসার সময় ক্লান্ত হাতগুলো দেখে শিখিনি ছায়া দিলে হাত বুক সব বিছিয়ে দিতে হয়। সেখানে ঘাম হয়, ধুলো পড়ে, এমনকি বেরঙিনও হয়ে যায়। অথচ বাবার দিকে দেখি। দূর থেকে দেখি একটা বাবামা-হারা সন্তান কেমন অসহায় একাকী চেনা পথে বাড়ি ফেরে রোজ৷ অভ্যাসবশত ভাতের থালায় ধরতেচায় মায়ের আলতা পাড়শাড়ি আর বাবার বাদামী আঙুল।
বহুদিন হল বাড়ি থেকে বাংলা থেকে দূরে থাকি। কাল শোকের খবরটা শোনার পর থেকে মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে৷ হয়তো ভয়৷ rme দাদার জায়গায় একদিন আমাকেও দাঁড়াতে হবে। আজও যখন বাড়ি থেকে আসি বাবা গাড়িভাড়া দেয়, হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, "রেখে দে রাস্তায় লাগবে।" যখন বাড়ি যাই, বাবা বাজার থেকে সব চেয়ে বড় কাতলামাছের মাথাটা নিয়ে আসেন৷ অথচ এক এক সময় বাবার ওপর আমার কত অভিমান জমে যায়৷ বাবা আমার মতো ভাবতে পারে না, আচ্ছা, আমার মতো ভাবাটা কি সম্ভব? আমি যেভাবে জীবন দেখি সেভাবে আমার বাবা দেখলে আমি কি অবাক হতাম না? আমিও কত অবুঝ! ঠিক বাবার মতন।
এখানে যখন লিখতে আসি, মাসখানেক আগে তখনও ভাবিনি নিজের কাউকে নিয়ে এতকিছু লিখব। কিন্তু মনটা সেই জায়গায় নেই যে নতুন কিছু ভাবি পোস্টের জন্য। বারবার চোখের সামনে বাবা ভেসে আসছে। কাল rme দাদা লিখেছিলেন, আমার হৃদয়টা আজ শত টুকরো হয়ে গেল। আমরা আসলে ভয় পাই। ভয় পাওয়া আমাদের ধর্ম। ভেঙে যাবার ভয়। হারিয়ে ফেলার ভয়৷ সেই ভয়ে ভেতরটা কুঁকড়ে আসে।
সত্যিই তো আমি কোনদিনও বাবা হতে পারব না৷ বাবাকে বাবা হিসেবে চিনব কিভাবে? না চিনব না৷ তাই বাবাকে নিয়ে কিছু লেখার আগে নিজের ভেতর খুঁজি কতখানি বাবা আছে৷ আয়নার সামনে দাঁড়াই, একটুও কি বাবা নেই!
বাবা গো!
তোমার বড্ড অভিমান আমি তোমায় নিয়ে লিখি না৷ আমি তোমায় রোজ ফোন করি না৷ তোমায় নিয়েও লিখি বাবা, শুধু তোমায় দেখাতে পারি না, ঠিক যেভাবে তুমি দেখাতে পারো না আমায় কতখানি ভালোবাসো। জানো বাবা এই যে কথা হলেই বলো, 'এবার সংসার থেকে ছুটি হয়ে গেলেই বাঁচি'। আজ ভারী মনে হচ্ছে তুমি আমাদের দিন গুনতে শেখাও। কানের মধ্যে এই কথাটার অনুরণন ঘটিয়ে তোলো তোমার দিন ফুরিয়ে আসছে৷ এ তোমার মায়ার কথা। হয়তো এমন ভাবো, হঠাৎ চলে গেলে যদি আমি বা আমরা নিতে না পারি! হঠাৎ চলে যাওয়া তো সত্যিই কঠিন বলো, যেবার ছোট মেসোমশাই মারা গেলেন, সারারাত বৃষ্টি হল৷ আমি তখন ক্লাস টেন৷ আমায় নিয়ে গেলে না, ভাবলে মৃত মানুষ কেমন দেখতে হয় তা আমার না দেখাই ভালো, কিংবা বন্ধু বাবা যে আর কোনদিন 'মোনাই' বলে ডাকবে না সেই সত্যের মুখ দুম করে বিনা নোটিশে যেন না পড়ি৷ সন্তানদের কিভাবে আগলে রাখতে হয় বাবা তোমার কাছে থেকেই শেখার। মাও আগলায়৷ কিন্তু তোমার মতো না। জগৎ-সংসারে কিছুই তোমার মতো নয় গো বাবা৷ তোমার চুলে পাক ধরেছে৷ অথচ আজও ভাবি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা তুমিই।
এই কথাটা শুনলে হয়তো তুমি আমায় লজ্জা পেতে বলবে৷ কিন্তু তা নয়, একবার বায়লোজিক্যালি ভাবো, ছেলে মেয়ে, মেয়ে ছেলে হিসেবে৷ দেখবে তুমিও আমার প্রতি খানিকটা বেশিই পজেসিভ৷ আমার প্রতি তোমার আকর্ষণ কতখানি৷ হলই বা পুতুলের বেশে৷ কিন্তু কোন ছেলে যদি আমার গায়ে একটাও আঁচড় টানে তুমিই কি মাকে ছাপিয়ে ছুটে আসবে না আমায় রক্ষা করতে? ভাববে না আমি এখনও তোমার ছোট্ট লতানো গাছ। মা তো জানে আমি বৃক্ষ হয়ে উঠেছি৷ ঠিক যেভাবে মা ভাবে তার ছেলে এখনও ছোট, অপরিণত।
আজ সকাল থেকেই ভেবেছি, জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য... সত্যিই তো! যেভাবে জীবন নিজের মতো খেলে চলে, পায়ে পায়ে কখন কোথায় কিভাবে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে কে জানে?
জানো বাবা, একবার কবি বৈজয়ন্ত রাহার লেখায় পড়েছিলাম, "কখনও কখনও বড় হারানোর দুঃখ / ছোট ছোট হারানোর দুঃখে হালকা হয়ে যায়।/ বাবার মৃত্যুর পর সাতদিন কিছু খেতে পারিনি/ ভেবেছিলাম জীবন আর চলবে না।" আতঙ্ক গ্রাস করেছিল। চোখ বুজে খানিকটা শ্বাস নিয়েছিলাম৷ পরের লাইনগুলো পড়ব না, পড়ার সাহস ছিল না ভেবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কবিমন ছাড়ল না৷ চোখ টেনে নিয়ে গেল, নীল ফাউন্টেন পেনে উনি লিখেছেন, " তোমাকে হারানোর দুঃখ/ চাকরী চলে যাবার দুঃখ / মায়ের গয়না চুরি যাবার দুঃখ / তাকে কি রকম নিরুদ্দেশ করে দিয়ে যায়।" ঠাকুমা চলে যাবার পর তোমায় খুব একা হয়ে যেতে দেখেছি৷ প্রতিদিন খাবার টেবিলে বসে তুমি তোমার মা কে খুঁজতে, কোনদিন তাকে ছাড়া খাওনি৷ ঠাকুমা তোমার মজ্জাগত অভ্যেস ছিল৷ দাদু চলে যাবার পর তুমি কি আরও একা হয়ে গেছ বাবা? তুমি সেদিন সকালে দাদুকে চা খাওয়াতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলে দাদুর বুকের ওপর। এখনও কি সেই একই ভাঙন আছে? নাকি তোমার ভেতর জেগে থাকা সন্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে গেছে। আজ কেবল বাবা হয়ে আমাদের মাঝে আছো। ভাঙা জিনিস জোড়া লাগে না বাবা, আর অনেক টুকরো হলে তা তো ছড়িয়ে যাবেই আর একদিন গুছিয়ে উঠতে না পারার কারণে হারিয়েও যাবে৷
দর্শনটা আমি তোমার থেকে বুঝতে শিখেছি৷ তবে তোমার মতো দূর্বল হৃদয়ের জালে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারিনি। এই বাস্তব জীবন আমায় তা হতে দেয়নি৷ কিন্তু আমি জানি যেদিন আমার কোল শূন্য করে জীবন খালি করে তুমি চলে যাবে, শিরায় শিরায় যে নদী ছুটে যাচ্ছে সেখানে হরতাল ঘোষণা হবে৷ কেউ জানবে না, দেখবেও না চোখের পেছনে পর্বতমালা নিজের জায়গা করে নিতে মানচিত্র থেকে বাকি সমস্ত ভূমিই গিলে খেয়ে নিয়েছে৷ তুমি তো জানবে বাবা৷ তুমিই জানবে৷ আমি অন্তত সেটুকুই জেনে রাত্রিবেলায় ক্লান্তির দিকে মুখ করে বসে থাকব। মনে মনে বলব, তুমি যেও না বাবা৷ পৃথিবীর সমস্ত বাবাদের বলে দাও, কেউ যেন তার সন্তানের ঘর খালি না করে দেয়৷ তুমি বললে শুনবে না? শুনবে, বাবা তোমার কথাই শুনবে৷ অন্তত আরও একটা বাবাকে বলো, অন্তত নিজেকে বলো৷
বাবা...
বন্ধুরা, শুধু নিজের বাবা নয়। আপনার চারপাশে প্রতিটা বাবার যত্ন দিন। বাবাদের আগলে রাখুন যত দিন পারবেন৷ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি সকলের বাবা ভালো থাক। আর টিনটিনের বাবা তার বুকে বাবাকে নিয়ে সন্তান লুকিয়ে সমস্ত শোক সহ্য করতে করতে আরও অনেকটা বড় গোছের ছায়া প্রদানকারী বটগাছে পরিণত হয়ে যায়৷
rme দাদা আপনাকে ট্যাগ করতে পারলাম না, যদি পড়েন, তাই আপনার উদ্দেশ্যে লিখে রাখছি, বাবা হারানোর শোক ভোলার নয়। তাও কঠিন দিনগুলিতে আপনার পাশে আমরা প্রত্যেকেই আছি। ঈশ্বর আপনাকে সহ্য ক্ষমতা দিন৷ বাড়ির বাকিদের আগলে রাখুন৷ বাবা চলে গেলে বাড়ির ছেলেরাই বাবা হয়ে ওঠে। আপনিও এখন বাকি সবার বাবা, সবার ছাতা। নিজেকে সামলে নিতে হবে৷ ঈশ্বর আপনাকে শক্তি দিন। ক্ষত সারবে না, তাও সেরে উঠুন।
আসি,
টা টা।
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। তবে বর্তমানে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ বর্তমানে ভারতবর্ষের পুনে তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
আসলেই দিদি! আমারো একই ভয়ই হচ্ছে! হারানোর ভয়! দাদা যে পরিস্থিতিতে আছেন, সেই পরিস্থিতিতে আমার নিজেকেও একফিন দাঁড়াতে হবে! ভাবলেই আর মানতে পারছি না! আমার জেঠ্যুও যখন বিদায় নেন চিরতরে, আমার বার্ষিক পরীক্ষা, তাই আমিও যেতে পারি নি। হুট করে একটা ফোনকলে মেনে নিতে হলো যে আর কোনদিন জেঠ্যুকে দেখতে পারবো না! 😭 পৃথিবীর কিছু কিছু নিয়মের কাছে আমরা বড্ড অসহায়! দাদার পরিবারের সকলে এই শোক সহ্য করার শক্তি পাক, এটাই চাইয়া। আর দাদার বাবার আত্মার শান্তি কামনা করি মন থেকে।
অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনিটা বড্ড উদাস হয়ে যায়। কত কিই ভাবি। তাও কঠিন বাস্তবের সাথে চলার চেষ্টা করছি৷ সবই তো মেনে নিতে হবে৷ কি করা যাবে৷ এটাই জীবন।
এই লেখার কোনো মন্তব্যই যেন যথেষ্ট নয়৷ বাবা নামটি আসলে কী তা হয়ত আমাদের বুঝে ওঠার আগেই বাবারা চলে যান৷ বাবা আসলে জীবনের সবথেকে নিরাপদ একটি ছায়ার নাম৷ লেখাটি অনেক উচ্চমার্গের ও অনুভবের। পড়তে পড়তে অবাক হচ্ছিলাম৷ তোর কলম সোনায় মোড়া৷ যত পড়ি তত মুগ্ধ হয়ে যাই রোজ৷ মানুষের মনের কথাকে অসাধারণ দক্ষতায় লিপিবদ্ধ করার ক্ষমতা আছে তোর৷ এটাই হয়ত প্রকৃত দর্শন৷ ভালো থাকিস৷ এমন কলমের যত্ন নিস
কি যে লিখেছি আমি নিজেই জানি না। তাও লিখেছি। মন যা বলেছে তাই লিখেছি৷ তোমার ভালো লেগেছে শুনে আনন্দ হল। ভালো থেকো। জেঠুর খেয়াল রেখো৷