আমাদের লেখা গদ্যগুলি সুখপাঠ্য করার উপায় (পর্ব-১) || জেনারেল রাইটিং
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
কেমন আছেন আপনারা? আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় বেশ ভালই আছেন। আমিও যেমন থাকি তেমনই আছি। রোজই চেষ্টা করি দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে নানান ধরনের পোস্ট লিখতে। হ্যাঁ আমি লিখি। পোষ্টের মাধ্যমে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখি। সে জীবনের গল্পই হোক বা কিছু বানানোর গল্প। আর লেখার সময় প্রতিনিয়তই ভাবি কিভাবে লেখাগুলো সুখপাঠ্য করা যায়। অর্থাৎ পড়তেও ভালো লাগবে এবং পড়ার পর মনের মধ্যে সুন্দর অনুরণন চলবে।
যখন পত্রিকার জন্য বা ভালো লেখার জন্য লিখতে শুরু করি, নানান অগ্রজ কবি লেখকদের সাথে পরিচিত হয়েছি৷ প্রত্যেকেই কোথাও না কোথাও অনেকটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন কিভাবে নিজের লেখাকে ক্রমশ উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া যায়। সেই সমস্ত কথারই কিছু অংশ আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
কিন্তু কেন?
যেহেতু স্টিমিট ডিসেন্ট্রালাইজড প্ল্যাটফর্ম, এখানে সবাই সবার লেখা দেখতে পায়। সিস্টেম যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের লেখাগুলো থেকে যাবে। তাই কোথাও গিয়ে মনে হয় লেখাগুলো বা যেকোনো ক্রিয়েটিভিটি এতটাই উন্নত হওয়া উচিত যা বর্তমানে অন্যান্য কমিউনিটির সদস্যরা এবং ভবিষ্যতের প্রজন্ম যখন দেখবে বা পড়বে তারা ভাববে এই মানুষগুলোর লেখাতে শেখার আছে, তা বিবেকের কথাই হোক বা জীবনের কথা, নানান অনুভূতির কথা কিংবা লেখার গঠনশৈলী।
এই সমস্ত কিছু চিন্তা করে আজ ঠিক করলাম সামান্য কিছু জরুরী কথা বলব যার উপর ভিত্তি করে আমাদের প্রত্যেকেরই লেখার গঠন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠবে।
তাহলে চলুন দেরি না করে শুরু করি, প্রথমেই আপনাদের জানাই
শব্দের পুনরাবৃত্তি
আমরা প্রত্যেকেই ভয়েস টাইপিং করে লিখি, খুব স্বাভাবিক, কারণ রোজ দিন এতো লেখা মোবাইলে টাইপ করতে গেলে আঙুল খারাপ হয়ে যায়। আমি যখন প্রবন্ধের কাজ করি এই পন্থা ছাড়া কোন উপায় নেই। তবে জানেন শুরুর দিকে প্রচুর গন্ডগোল করেছি, একটা লেখা লেখার পর ঘুরে পড়তাম না এদিকে ভয়েস টাইপিং এর কারণে অদ্ভুত সব শব্দ লেখা হয়ে গেছে। পরে যখন পান্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের সাথে কথা বলবো বলে ঠিক করি সেই প্রবন্ধ জমা করতে গিয়ে মাথায় হাত। সমস্তটা নতুন করে অনেক কষ্ট হয়েছিল। সাথে ইচ্ছে হয়েছিল নিজেকে থাপ্পড় মারি। এই সময় একটা জিনিস বুঝেছিলাম যখন টাইপ করে লিখি, তখন শব্দের প্রয়োগ এক রকম হয়, আর মুখে বলার সময় অন্যরকম। অতএব লিখিত ভাষা আর মৌখিক ভাষার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। যারা লিখিত ভাষাই মুখে বলে টাইপ করার উপায় শিখেছেন বা অভ্যেস করেছেন তারা এই গিঁট ছাড়িয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যারা পারেননি তাদের প্রত্যেকের লেখায় কিছু শব্দের বারংবার প্রয়োগ দেখা যায়। এই যেমন, আসলে, মানে, অর্থাৎ, মূলত। পাঠক হিসেবে যখন নিজের লেখা নিজেই পড়ি, মনে হয়, সংসারে আর শব্দ কি শিখিনি নাকি অভিধানে নেই! এই ধরনের শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার লেখাকে অনর্থক ভারী করে তোলে। লেখা হবে হালকা ও গতিশীল। পড়তে গিয়ে যদি বারবার হোঁচট খেতে হয় সেই লেখা কখনোই সুখপাঠ্য নয়। তাছাড়া একটা লেখা লেখার পর তাকে অন্তত দু'বার নিজেরই পড়া দরকার জনসমক্ষে আনার আগে৷
একই অর্থপূর্ণ বাক্যের পুনরাবৃত্তি
অনেক সময় হয় কি, বলার মতো অনেক কথা থাকে না বা নানান ধরনের চিন্তাভাবনাও থাকে না। কিন্তু নির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যা পূরণ করতে হবে, অগত্যা অনেকেই একই বাক্যকে অদল বদল করে লিখে ফেলে না হলে একই অর্থের এদিক ওদিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানান বাক্য লিখে ফেলে। এইসব ক্ষেত্রে লেখাগুলো পড়ার ধৈর্য আর থাকে না। তখন মনে হয় ভাতে অনেক বেশি কাঁকর, বারবার দাঁতে লাগছে। দুটো কথা বলার থাকলে দুটোই বলা ভালো। বিশ্লেষণ না করতে পারলে করব না কিন্তু অনর্থক শব্দ ব্যয় করবো না। জানেন আমায় এক কবি বলেছিলেন —
শব্দের অনেক দাম, অযথা খরচ করো না।
অতিরিক্ত আমি বা আমার বা আমাকে-র প্রয়োগ
"আমার মাছ খেতে ভালো লাগে। আমি তাই মাছ ভালো রান্না করি। আমার রোজ মাছের বড় পিসটা নিজের পাতে না পেলে আমার খুব মন খারাপ হয়। আমি যদিও সবাইকে দিয়ে খেতে ভালোবাসি কিন্তু আমি আমারটাও দেখি। আমাকে সেটা বেশি সুখ দেয়।"
এই একটা বাক্য লিখলাম, এখানে সবটাই আমার কথা তাই বারংবার আমি কেন্দ্রিক শব্দগুলো ব্যবহার করেছি।
"মাছ খেতে ভালোবাসি বলে রান্নাটাও জমিয়ে করি। কিন্তু রোজ মাছের বড় পিসটা পাতে না পেলে খুব মন খারাপ হয়। যদিও সবাইকে দিয়ে খেতেই ভালোবাসি, তবে নিজেরও খেয়াল রাখি- যা বড্ড সুখের"
এই বাক্যটাতে আমি কিন্তু শব্দগুলো নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করিনি। যারা এই ব্লগটা পড়ছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন পার্থক্যটা কোথায়।
আমি তো আসলে কেউই না। আমার কিই বা দাম এই বৃহৎ পৃথিবীতে?
ক্রিয়াপদের সঠিক প্রয়োগ
একটা বাক্য মানেই তার মধ্যে ব্যাকরণের নানান ভাগ থাকে। লিখিত ভাষার ক্ষেত্রে সবথেকে জরুরি ক্রিয়াপদের সঠিক প্রয়োগ। সহজ করে বললে বলা যায় ক্রিয়াপদের সঠিক জায়গা নির্বাচন। এছাড়াও একটি বাক্যে অধিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার না করাই ভালো। সাথে সমাপিকা ক্রিয়ার যত কম ব্যবহার ততোই সুখপাঠ্য। সেক্ষেত্রে একটা বড় বাক্য ভেঙে ছোট বাক্য লেখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে - সেক্ষেত্রে একটা বড় বাক্যের জায়গায় ছোট ছোট বাক্য প্রয়োগই বুদ্ধিমানের কাজ। উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে দিলাম ক্রিয়াপদের আলঙ্কারিক ব্যবহার। বিশেষ বিশেষ জায়গায় ক্রিয়াপদকে টেনে সামনে নিয়ে এলেও পড়তে ভালো লাগে৷ যেমন,
- আমি খেতে ভালোবাসি, আমি খেলতে ভালোবাসি, আমি ঘুরতে ভালোবাসি, আমি ঘুমোতে ভালোবাসি-
আমি খেতে, খেলতে, ঘুরতে আর ঘুমোতে ভালোবাসি / আমি ভালোবাসি খেতে, খেলতে, ঘুরতে আর ঘুমোতে।
- গতরাতে চাঁদ আকাশে উঠেছিল- গতরাতে চাঁদ উঠেছিল আকাশে।
আশাকরি বিষয়টা পরিষ্কার করতে পারলাম।
বিশেষণের সঠিক প্রয়োগ
বিশেষণ হলো গদ্য বা পদ্যের শুধু না ভাষার অলংকার। এক একটা বাক্য মনে থেকে যায় কেবলমাত্র উপযুক্ত শ্রুতিমধুর বিশেষণ ব্যবহারের ফলে৷ যেমন,
আমি গোলাপ ভালোবাসি। - আমি লাল টুকুটুকে গোলাপ ভালোবাসি।
আকাশে শরতের মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি ক্যামেরা হাতে। - শরতের ঘন নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ছেঁড়া মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে আছি ক্যামেরা হাতে
সবটাই সৌন্দর্যের খাতিরে সাজানো। ঠিক যেভাবে আমাদের ঘরগৃহস্থালী সাজাই।
আজ আর বাড়াবো না। বাকি কথা পরের সপ্তাহে বলব। যারা পড়তে আগ্রহী সুস্থ শরীরে অপেক্ষা করুন। ভালো থাকুন বন্ধুরা, আমি আসি কেমন?
টা টা
পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
কলমওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
https://x.com/neelamsama92551/status/1857748459081593097?t=offDcBkg1JJrDk0D9h3KMA&s=19
অসাধারণ একটি লেখা পোস্ট করেছেন। এ লেখা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সম্পূর্ণ লেখাটি আমি পড়েছি কিন্তু কি কমেন্ট করবো বুঝতে পারছি না।আমাদের লেখার উপর যত্নশীল হওয়া উচিত। আমি কেন্দ্রিক শব্দগুলো আমরা একটু বেশি ব্যবহার করি। আমাদের সকলের এমন ভাবে লেখা উচিত যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম লেখাগুলো পড়লে বলতে পারে এদের থেকে কিছু শেখার আছে।
অনেক সুন্দর লাগলো আপনার লেখাগুলো। ধন্যবাদ দিদি।
সব সময় যে আমিও এই নিয়ম মেনে লিখতে পারি তা নয় তবে চেষ্টা করি মানতে। আরও অনেক কিছু আছে। পরে আরেকটা পর্ব লিখব।
অসাধারণ একটি প্রবন্ধ এবং শিক্ষনীয়ও বটে। এই লেখার মাধ্যমে অনেকে অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আর লেখার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া ব্লগের প্রথম শর্ত বলে আমার মনে হয়। বেশিরভাগ লেখাতেই দেখি প্রচুর বানান ভুল এবং বাক্য গঠনে বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের যথাযথ ব্যবহার নেই। ভয়েস টাইপিং করলেও তা আবার একবার ভালো পড়ে পড়ে নেওয়া উচিত। লেখায় যত্নশীল না হলে সেই লেখা পড়তেও ভালো লাগেনা।
ঠিক ঠিক নামিয়েছি বলো? ভয়েস টাইপিং করে আমার কি অবস্থা হয়েছিল বলো? উফফ! ভাবলেই আতঙ্ক হয়।
দিদি আজকে আপনার এই পোস্টটা পড়ে সত্যিই অনেক কিছু শিখলাম। যদি কেউ তাদের লেখাকে আরও সুন্দর করতে চায় তবে আপনার এই পোস্টটি তাদের জন্য অনেক সাহায্য করবে। কোন কিছু লেখার প্রত্যেকটি বিষয়কে আপনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। অনেক সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের সাথে বিস্তারিতভাবে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিদি।
চেষ্টা করেছি ভাই। যা আমি শিখেছি সেটাই শেয়ার করেছি। আরও একটি পর্ব লিখব। আরও কিছু বিষয় নিয়ে।