পিয়ার মিডাস টাচে চিংড়ির পাতাবাহার

।। নমস্কার বন্ধুরা।।


~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~


নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত



1000010622.jpg

টাটকা তাজা চিংড়িমাছ

কী ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে বসে আছি। আর সশব্দে ভিজে যাচ্ছে শহর। বৃষ্টি কোন কালেই আমার প্রিয় নয়৷ তাই ভালোথাকা মাথায় উঠেছে। আপনাদের তো গরমে পুরো নাজেহাল অবস্থা তাই না? কেমন আছেন এই গরমে? অনেক অনেক জল খাচ্ছেন তো? বর্ষা আসতে বেশি দেরী নেই তাই এর মধ্যেই আপনারা কিন্তু প্রাকৃতিক শীততাপনিয়ন্ত্রক অর্থাৎ গাছ লাগানোর জন্য তৈরি হয়ে যান৷ জানেন তো এসি ফ্রিজ এগুলো আমরা যত কম ব্যবহার করব ততই প্রকৃতি বাঁচবে আর গরমও কমবে। এই গরমে মানুষ ঘরে ঘরে এসি বসিয়ে নিচ্ছে কেউ আর গাছ লাগানোর কথা ভাবছে না৷ সকলেই আজকাল সাময়িক সুখ চায়৷

1000181749.jpg

পিয়ার মিডাস টাচে আপনাদের আমন্ত্রণ

যাইহোক, আজ আপনাদের জন্য একটি সহজ সরল রান্নার রেসিপি নিয়ে এলাম। এখানে তো আগে কোন দিন হেঁশেলের খাতা খুলিনি তাই কোন গল্পই বলা হয়নি৷ আজ যখন প্রথমবার পাকশালার দরজা খুলেছি তার হেঁশেলের একটা নাম দিই। পিয়ার মিডাস টাচ। পিয়া কেন? জানতে ইচ্ছে করছে? তাহলে তো একটুখানি গল্প করতেই হয়।

1000181763.jpg

পিয়ার ঠাকুমা আর ঠাকুমার পিয়া

পিয়া আমার ঠাকুমার দেওয়া নাম। ঠাকুমা চলে যাবার পর থেকে সেই নামে আজ আর সেভাবে প্রকাশ্যে কেউ ডাকে না৷ অথচ নামটি আমার ভীষণ প্রিয়। জানেন বন্ধুরা আমার মা তো স্কুলে পড়াতেন তাই একান্নবর্তী পরিবারের সকলের মাঝেই বড় হয়েছি। সব থেকে সান্নিধ্য যার পেয়েছি তিনি আমার ঠাকুমা। ঘর গোছানো থেকে গাছের পরিচর্যা ও নানান নতুন জিনিস সংগ্রহের নেশা আমি ঠাকুমার থেকেই পেয়েছি। ছোট থেকে ঠাকুমা খুব পরিচ্ছন্ন থাকতে শিখিয়েছেন। এমনকি নিজের কাজও নিজেই করতাম৷ সে কারণেই হয়তো আজ কোন কাজের দিদি ছাড়াই আমি সব কিছু হাসিমুখে করি৷ আমার ঠাকুমা ছিলেন তাম্রলিপ্ত রাজার নাতনি৷ রাজবাড়িতে বড় হওয়ার দরুন তিনি নানান ধরণের রান্না জানতেন৷ বিবাহিত জীবনে তাঁর রাজার ছাপ না থাকলেও রান্না ও খাওয়াদাওয়ায় সেই চালচিত্রের বদল হয়নি। আসলে হেঁশেল যে গৃহকর্ত্রীর একচ্ছত্র অধিকারের আওতায় পড়ে৷ ছোট থেকে ঠাকুমার গা ঘেঁষে থাকার ফলে আমি এমন অনেক রান্নাই শিখেছি যা বাড়ির আর কেউ জানে না৷ ঠাকুমা নেই প্রায় সতেরো বছর। আমি মায়ের বাড়ি গেলে যখন পিসিরা আসেন দেখা করতে তখন কোন কোনদিন এক আধটা পদ রান্না করি। পিসিরা বুঝতে পারেন না তার মায়ের হাতের রান্না নাকি আমার। এমনও হয়েছে মেয়েরা খেতে বসে মায়ের কথা ভেবে কেঁদেছেন৷ ঠাকুমার হাতেই আমার রান্নার হাতেখড়ি৷ তাই তাঁর দেওয়া নাম নিয়েই আমার হেঁশেলের নামকরণ৷ মিডাস টাচ কেন? তা আমার রেসিপি অনুযায়ী রান্না করে দেখবেন। ঠিক বুঝে যাবেন।

1000174826.jpg

চিংড়ির পাতাবাহার

চিংড়ির পাতাবাহার নামটি আমার দেওয়া। ঠাকুমা বলতেন চিংড়ির লটপটি। নাম বদলেছি মানে রান্নাতেও বদল আছে বুঝতে হবে৷ ঠাকুমা বলতেন রান্না সব সময় উনুনে ভালো হয়। এদিকে মায়ের স্কুলের তাড়া থাকায় হু হু করে রোজের পঞ্চব্যঞ্জন গ্যাসওভেনে রান্না করে বেরিয়ে যেতেন৷ ঠাকুমার নাকি সেসব মুখে রুচত না৷ তাই বাড়িতে চিংড়ি মাছ থাকলেই এই পদটি রান্না করতেন৷

ঠাকুমার রান্নার সাথে আমার সংযোজন সমেত রেসিপিটি শেয়ার করছি।

উপকরণ

1000174761.jpg

রান্নার উপকরণের ছবি ১

1000181771.jpg

রান্নার উপকরণের ছবি ২

  • চিংড়িমাছ ৫০০ গ্রাম
  • লাউপাতা কুচো করে কাটা ৭-৮ টি বড় সাইজের
  • চৌকো করে কাটা আলু দুটি
  • পেঁয়াজকুচি দুটো মাঝারি সাইজের
  • দু ইঞ্চি আদা মিহি করে বাটা
  • কাঁচালঙ্কা পরিমান মতো
  • হলুদ গুঁড়ো পরিমান মতো
  • নুন পরিমান মতো
  • দু'চা-চামচ জিরা বাটা
  • দু'টেবিল চামচ পোস্ত বাটা
  • সরষের তেল চোখ বন্ধ করে একটু বেশি, কারণ চোখ খুলে দিলে হাত দিয়ে কেন জানি না তেল গলে না
  • ও হ্যাঁ রঙ চাইলে কাশ্মীরি লঙ্কাগুঁড়ো বা কাশ্মীরি শুকনো লঙ্কা ভিনিগারে ঘন্টা চারেক ভিজিয়ে বেটে নিতে পারেন

  • পদ্ধতি

    1000174767.jpg

    সব কিছু এক সাথে এক জায়গায়

    পদ্ধতি আর কি? কিছুই না, পোস্ত বাটা ছাড়া সব কিছু এক সাথে কড়াইতে দিয়ে ঠাকুমা শেষপাতের উনুনে আলাদা করে জ্বালানি না দিয়েই বসিয়ে দিতেন। প্রায় ঘন্টা খানেক। মাঝে সামান্য জল যোগ করতেন৷ আমার তো আর মাটির উনুন নেই তাই গ্যাসে বসিয়ে দিই। অবশ্যই কড়াই ঢেকে৷ এক ঘন্টা টানা একটা রান্নার জন্য গ্যাস খরচ করলে শ্বশুরবাড়িতে যদি সবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায় তাই প্রথমে একটু আঁচ কমিয়ে তারপর বাড়িয়ে তারপর আবার কমিয়ে রান্না করেছি। তবে পোস্তটা কিন্তু খুব একটা রান্না করিনি। সব শেষে মিশিয়ে আর ওই বন্ধ চোখেই মিথ্যে মিথ্যে অল্প পরিমান (মানে প্রথমে যা দিয়েছিলাম তার থেকে সামান্য কম বা বেশি) তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নিয়েছি। আমার সংযোজনটি কি বলুন তো? খুব সোজা, পোস্ত বাটা আর রান্না করার সময় দেওয়া সামান্য পরিমান সরষের তেল। কি বুঝছেন বন্ধুরা? আমার ঠাকুমা কিন্তু বাজেট ফ্রেন্ডলি রান্না করতেন তাই না?


    পরিবেশন

    1000181818.jpg

    গয়না বড়ির সাথে পিয়ার হাতের চিংড়ির পাতাবাহার

    তখন পঞ্চব্যঞ্জনের সাথে পরিবেশন হত৷ আমার এখন এতো কিছু ভালো লাগে না। তাও আবার জিভে জল আনার এমন একটা পদ দিয়ে৷ এর স্বাদ নিতে তো আলাদা করে এক থালা ভাত লাগবে৷ কিন্তু পেটেও তো ঢোকাতে হবে৷ তাই আমার থালায় একটি গয়না বড়ি ভাজা সহ এক বাটি চিংড়ির পাতাবাহার দিয়ে খেয়ে নিলাম এক বাটি ভাত৷

    ঠাকুমা আজ আর নেই৷ তাও তাঁর শেখানো রান্নার ভেতর আমি যেন তাঁকেই ধরে রাখি৷ সেই মানুষটি যার সাথে একদিন কোমর বেঁধে ঝগড়া করতাম, যে কিনা 'চললুম'বলে একেবারেই চলে গেল।

    এমন করে রান্না করে দেখবেন বন্ধুরা। পারলে মাটির কড়াইতে করবেন৷ বিশ্বাস করুন কখন যে হাঁড়িতে একটিও ভাতের দানা পড়ে থাকবে না টেরই পাবেন না৷

    আর কি? নোটে গাছটি মুড়লো আমার গল্পটি ফুরলো৷ আজ আসি? আপনারা ভালো থাকতে ভুলবেন না বন্ধুরা। অনেক অনেক গাছ লাগান আর গাছের আদরে ভালোবাসায় শীতল বাতাসের আগামী ফিরে আসুক আমাদের জীবনে। ঠিক বললাম তো? ভালো থাকবেন বন্ধুরা, সুস্থ থাকবেন। আবার আসব জ্বালাতে।

    টা টা!

    সমস্ত ছবিই আমার মুঠোফোন স্যামসাং গ্যালাক্সি F54 এ তোলা।



    ~লেখক পরিচিতি~

    1000003467.jpg

    আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। তবে বর্তমানে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ বর্তমানে ভারতবর্ষের পুনে তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা




    Sort:  
     last year 

    অসাধারণ একটি রেসিপি। আর যেভাবে গল্পের মত ব্যাখ্যা হল তার জুড়ি নেই। সুলেখিকার হাতে এভাবেই যেকোনো বিষয় প্রাণ পায়। আর যোগ্য সঙ্গত করেছে ছবিগুলি। যেন একটা ক্রমিক ধারায় সাজানো এক নিবন্ধ। অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে অসাধারণ এক রেসিপি।

     last year 

    সবটাই তো একটা গল্প৷ প্রেম, প্রকৃতি, পূজা। মহাগল্পের ভেতর ছোট ছোট আরও কত গল্প৷ তোমার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। ভালো থেকো৷ আমার রান্নার ব্লগ ও রান্নার গল্প তোমার ভালো লেগেছে শুনে সত্যিই ভালো লাগল৷ এ আমার বড় প্রাপ্তি। একদা তো এও ভাবতাম রান্না সম্পর্কে আমি কোন ব্লগই লিখতে পারি না৷ কিন্তু এখানে এসে নিজেকে মেলে ধরার জায়গা পেলাম৷ তাই না?

     last year 

    আপনার ঠাকুমা এখন না থাকলেও আপনি ওনার স্মৃতি মনে রেখেছেন আর উনার রান্না মনে রেখেছেন জেনে ভালো লাগলো। চিংড়ির পাতাবাহার রেসিপি দারুন হয়েছে। মনে হচ্ছে খেতে অনেক মজার হয়েছিল। আপনার রান্নায় নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম।

     last year 

    আমার রান্নার শখটাও ঠাকুমার থেকেই পাওয়া৷ বা নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করা।

    এই রেসিপিটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দিত হয়েছি। অনেক ধন্যবাদ জানাই৷ কখনও বাড়িতে রান্না করে খেয়ে দেখবেন আর অবশ্যই জানাবেন কেমন লেগেছে৷

     last year 

    মজাদার রেসিপিটির সাথে সাথে আপনার ঠাকুমার দেয়া সুন্দর নাম এবং ঠাকুমা ও পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।আপনার রেসিপিটি ভীষণ চমৎকার লাগছে। চিংড়ি মাছ ভীষণ সুস্বাদু একটি মাছ আর তা যদি আপনার ঠাকুমার রেসিপিটি হয় এবং ঠাকুমার রেসিপিটিতে একটু বদল এনে রান্না করা হয় তবে তো কোন কথায় নেই।আপনি চমৎকার সুন্দর ও সুস্বাদু করে রেসিপিটি করেছেন এবং তা ভাগ করে নিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর ও সুস্বাদু রেসিপিটি আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্য।

     last year 

    দত্তা, রেসিপি ভাগ করে নিতে পারার আনন্দ অনেক বেশি, আমার মা বলেন, দুঃখ ভাগ করলে কমে, আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে৷ রান্নাও তো এক ধরনের শিল্প৷ কোন ছেলেবেলায় খুন্তি ধরেছি মনে নেই৷ তবে আজ এই শিল্প বাঙালি হিসেবে প্রাণে গেঁথে আছে৷ কখনো সুযোগ হলে অবশ্যই নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াব৷ কিন্তু আপনি যদি পদ্ধতি ফলো করে বাড়ির সবাইকে চিংড়ির পাতাবাহারের আনন্দ দিতে পারেন আমারও খুশি দ্বিগুণ হয়৷

     last year 

    দারুণ স্বাদের কিছু উপস্থাপন করেন, আমি তো নিজেকে লোভী ভাবতে শুরু করেছি স্বাদ নেয়ার জন্য, হা হা হা।

     last year 

    খাবার দেখলে আমাদের সবারই জিভে জল আসে। কেউ ব্যতিক্রমী নই। তবে সুযোগ হলে একদিন অবশ্যই খাওয়ানো যাবে৷