'মোমবাতির কার্নিশ' বইটি পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া। বুক রিভিউ পোস্ট।

in আমার বাংলা ব্লগ9 days ago (edited)

বুক রিভিউ পোস্ট

☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️


IMG_20230315_120203.jpg

বইটির কভার ছবি

পড়ছিলাম মোমবাতির কার্নিশ। প্রথম দশকের কবি নীলম সামন্তের একগুচ্ছ সাহসী কবিতা। তিনি আপনাদের সকলের পরিচিত এবং এই ব্লগের লেখক @neelamsamanta। বইটির সবকটি কনটেম্পোরারি পোয়েট্রি। শূন্য দশকের পরে বাংলা কবিতার স্পষ্ট বাঁকগুলো খুব স্বচ্ছ কবি নীলমের কলমে। পড়তে পড়তে খুব স্বাভাবিক ভাবেই পা ফেলতে হবে কার্নিশে। নামকরণের সাহসিকতা এখানেই৷ মোমবাতির রূপক অসাধারণ। কবি ভেবেছেন গভীরে। স্পর্শ করেছেন নিজের না দেখা এবং না চেনা দিকগুলোতেও৷ বইতে বারোটি কবিতা৷ সবগুলোই সাজনো। ঝকঝকে পংক্তিগুলো পাঠকের কাছে খুব সহজে আপন হয়ে ওঠে। দিকভ্রান্ত হতে দেয় না।

1731341604439.jpg

বইটির ভিতর পাতার ছবি

প্রথমেই আসি কবির কলমের কাছে৷ কবি সৎ, এবং পাঠকের কাছে দায়বদ্ধও। তাই খুব সহজে লিখতে পারেন, "হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম শূন্যে / এতোকাল আমাকে কেউ ডাকেনি"। এখানে শূন্য অর্থে সন্ন্যাস। যেখানে কবি লিখছেন "গ্রহ নক্ষত্র থেকে তুলে আনি জুঁইফুল"। এভাবে শব্দের আড়াল ভাঙতে ভাঙতেই কবিকে পৌঁছতে হয়েছে কার্নিশে। সেখানে মোমের তাপ কবিকে আরও পুড়িয়েছে৷ এরপর তিনি স্পষ্ট বলেছেন "দশমিকের ডানদিকে যেও না / আমার শোবার ঘর"। কত দৃপ্ত উচ্চারণ। অক্ষরযাপনের চিহ্ন সবকটি কবিতার শরীরে৷ এভাবেই হয়ত কবিতার ভেতরে ফুটে ওঠে কবির আর্তি। আর নিজেকে কার্নিশে দাঁড়াতে দুবার ভাবতে হয় না কবিকে। সব কবিকেই একদিন কার্নিশে দাঁড়াতে হয়। তাকিয়ে দেখতে হয় নিজের আশপাশ। তরুণ কবি নীলম সেই কাজটাই করে ফেলেছেন প্রথম কাব্যগ্রন্থতেই।

IMG-20241113-WA0001.jpg

বইটির ভিতর পাতার ছবি

বইটিতে সমস্ত কবিতাই মেদহীন। খুব সহজে প্রান্তিক বিন্দুকে ছুঁতে কার্পণ্য নেই কোথাও। "সামান্য যা কিছু - মরুভূমির নাম করে রেখে এসেছিলাম বালির ভিতর। ছোট বড় অহংকার / ন্যুনতম অবরোধ-" কবিতায় এই সারবক্তব্যটুকু বলতে কোনো আড়ালের আশ্রয় নেন নি কবি৷ কবি অন্ধকারও চেনেন। অন্ধকারকে আলোর কাছে নিয়েও আসেন খুব যত্ন করে। তাই বলেন, "জন্মের সময় থেকে কতবার লাইনে দাঁড়িয়েছি হিসেব নেই / অথচ ভিড়ে জুতো ছিঁড়ে যাবার ভয়ে ফিরে এসেছি বহুবার।" এখানেই আলোকবর্তিকার সার্থকতা। আলোয় ফেরবার আর্তি। উত্তর আধুনিক কবিতাশৈলীতে এই আর্তিটুকু খুব উল্লেখযোগ্য। শূন্য দশকের পরে বাংলা কবিতা ঝরঝরে, সাহসী। উচ্চারণও নির্ভরতাহীন। কবি এই বোধটুকুকে গুছিয়ে রেখেছেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে। এক ফর্মায় অনেক বৈচিত্র্য, অথচ খুব পরিপাটি। উত্তর আধুনিকতায় চিন্তার ব্যপ্তিটুকু যে কবি পড়াশোনা করেছেন তার ছাপ স্পষ্ট। ঢেঁকুর কবিতায় তিনি বলছেন, "এভাবেই পার্লামেন্ট ভেঙে তৈরি করবে স্পেশ রিসার্চ সেন্টার"।

IMG-20241113-WA0003.jpg

বইটির ভিতর পাতার ছবি

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আগামীর স্বপ্নগুলো গুছোতেও ভুল করেননি কবি। আকাশ বলতে তিনি স্বাধীনতা বোঝেন। চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে কবিতায় সমাজতন্ত্রের কথা বলেন খুব গুছিয়ে। তাই তো পার্লামেন্ট পাল্টে যায় স্পেশ রিসার্চ সেন্টারে। "একটা কাক নিখুঁত ভাবে খেয়ে নিচ্ছে মরা পায়রার শরীর" - এই চরণে সেই সামাজিক ব্যধিটাই পরিণতি পায় প্রতিবিম্বে। নিজেকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। বলতে দ্বিধা করেন নি - "জুতোর দিকে তাকিয়ে মানচিত্র দেখি।"
কবি নিজেকে পোড়ান অহরহ। আগুনে হাত রেখে নিজের কবিতাকে শোধন করতে সঙ্কোচ করেন না। এক একটি কবিতা পাঠকের কানে কানে সেই কথাই বলে। নীরব অক্ষর যাপনে তিনি খুব দক্ষ। স্বপ্নের সামনে দাঁড়িয়েও নিজের কলমকে দৃঢ় ধরে রেখেছেন আগাগোড়া।
এরপরে আসি বইটির উপস্থাপনায়। পারস্পরিক প্রকাশনীর কাজ সবদিক থেকেই প্রশংসনীয়। প্রচ্ছদেও অভিনবত্ব। মোমবাতি ও শিখার অ্যাবস্ট্র‍্যাকট প্রেসেন্টেশন নজর কাড়ে পাঠকের। সাথে অন্ধকারের আবহ। সাদা কালো এই প্রচ্ছদ এককথায় লেখাগুলোকেই যেন সমর্থন যুগিয়ে গেছে বরাবর। সঙ্গে ঝকঝকে অক্ষর ও পংক্তিবিভাগ। এমনকি বিশেষ করে নজর পড়ে উৎসর্গের দিকে। উৎসর্গ "সেইসব স্বপ্নাদিষ্ট সন্ন্যাসীদের" - এখানেও অভিনবত্ব। সন্ন্যাসী শব্দটি ভীষণ ভাবে কবিতাগুলোর সমার্থক। এই সন্ন্যাসটুকুই কবিকে সাবালক করেছে আনাচেকানাচে। কবিতার বলিষ্ঠ উচ্চারণে একাকিত্বের কাছে হাত পেতে দিয়েছেন কবি। আর পরিবর্তে তুলে এনেছেন অসংখ্য মণিমুক্তো। ষোলো পাতেতেই বাজিমাত৷ কিন্তু খিদে বেড়ে যায় কবিতার ও কবির কলমের কাছে। একটানে বারোটি বারুদ ছুঁয়ে ফেলার পরে দাবী আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের। পাঠকও পুড়তে চায় অনবরত। কাব্যগ্রন্থ জুড়ে কবি নীলম সামন্তের সার্থকতা এখানেই।


বইয়ের নাম - মোমবাতির কার্নিশ
কবি নীলম সামন্ত
প্রকাশক - পারস্পরিক
প্রকাশ - কলকাতা বইমেলা, ২০২৩


Onulipi_08_07_01_37_53-removebg-preview.png

চিত্রগ্রহণ
ইনফিনিক্স হট ৩০
ক্যামেরা স্পেশিফিকেশন
৫০ মেগাপিক্সেল
স্ট্যাটাস
আনএডিটেড
চিত্রগ্রাহক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
লোকেশন
হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ
কভার ছবি এডিটিং সৌজন্য
অণুলিপি

🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

First_Memecoin_On_Steemit_Platform.png

hjh.png


Sort:  
 9 days ago 
 9 days ago 

দাদা আপনার বুক রিভিউ পড়ে আমারও বইটি পড়তে বেশ আগ্রহ হচ্ছে। আপনি খুব সুন্দর করে বইটির রিভিউ করার চেষ্টা করেছেন। আপনার রিভিউ বেশ দারুন হয়েছে। ধন্যবাদ দাদা।

 9 days ago 

নিজের বই রিভিউ তে কি আর কমেন্ট করব! আমি কি আদৌ এমন লিখেছি যতটা সুন্দর তোমার রিভিউ?

বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে নেই৷ তোমার জন্য অনেক শুভকামনা জানালাম।

এত্তটা আপ্লুত হয়েছি

 8 days ago 

নিলাম আপুর বেশ কিছু কবিতা পড়েছি যেগুলো উনি এখানে শেয়ার করেন। সত্যি চমৎকার উনার কবিতা গুলো। কিন্তু উনার যে এমন চমৎকার কবিতার বই আছে সেটা জানতাম না। আপুর কবিতা এবং সেগুলো অসাধারণ ভাবে বিশ্লেষণ করে সাবলীল ভাবে আপনার রিভিউ। চমৎকার লাগল আপনার পোস্ট টা। ধন্যবাদ আমাদের সাথে শেয়ার করে নেওয়ার জন্য।।

 yesterday 

এই বইটিও খুব চমৎকার ভাই। প্রত্যেকটি কবিতা মনে রাখবার মতো। আর ওর কবিতার বোধ অনেক উচ্চমার্গের। ধন্যবাদ এমন সুন্দর মন্তব্য করবার জন্য।