পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় লোকশিল্পের আয়োজন
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় লোকশিল্পের আয়োজন
সাহিত্য কেবলমাত্র কাগজের পাতায় আটকে নেই—তা রূপ নেয় মঞ্চে, সুরে, ছন্দে, এবং মানুষের প্রতিদিনের জীবনে। এই সত্যটাই যেন আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত "সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা"। প্রতিবছরের মতো এবারও নন্দন চত্বর হয়ে উঠেছে ছোট পত্রিকা ও লেখকদের এক মিলনক্ষেত্র, কিন্তু এবারের উৎসবকে বিশেষ করে তুলেছে বাংলার আঞ্চলিক সংস্কৃতির সংযোজন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত লোকশিল্পীরা এই উৎসবে এনে দিয়েছেন এক ভিন্ন মাত্রা—এক সজীব, প্রাণবন্ত রূপ।
নন্দন চত্বর ও তার সংলগ্ন এলাকা যেন রূপান্তরিত হয়েছে এক চলমান উৎসব-গ্রামে। রাস্তার দু’ধারে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিভিন্ন জেলার শিল্পীরা—কেউ বাঁশি বাজাচ্ছেন, কেউ ডুগডুগি; কেউ মুখোশ পরে ছৌ নৃত্যের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কেউ আবার করুণ সুরে বাউল গান গাইছেন। এই খোলা পরিবেশে এমন উপস্থাপনা সাধারণত শহরের দর্শকদের কাছে নতুন। মঞ্চভিত্তিক পারফরম্যান্স নয়—বরং সাধারণ মানুষের চোখের সামনে, একেবারে রাস্তার উপরেই নৃত্য-গান পরিবেশিত হচ্ছে, যেন মানুষের জীবনের সঙ্গে শিল্পীর সৃষ্টির সরাসরি সংযোগ ঘটছে।
উল্লেখযোগ্য ছিল পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্যদল, যারা বীরত্বগাথা ও পুরাণকথা অবলম্বনে এক অপূর্ব অভিনয় পরিবেশন করে। তাদের রঙিন মুখোশ, বর্ণময় পোশাক ও ছন্দবদ্ধ চলাফেরা উপস্থিত দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। পাশাপাশি বীরভূমের বাউলরা তাদের একতারার সুরে দর্শকদের মনে এনে দেন গ্রামবাংলার সরলতা ও আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ। দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আগত গম্ভীরা শিল্পীরা হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন, যা ছিল একেবারে সময়োপযোগী ও শিক্ষণীয়। এছাড়াও এই উৎসবে যোগদান করেছিলেন বহুরূপীরাও। যে শিল্প প্রায় বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
এই উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, হাওড়া ও দার্জিলিং-এর শিল্পীরাও। প্রত্যেকে নিজেদের এলাকার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে এসেছেন, তা কখনও লোকনৃত্য, কখনও বাউল-ভাটিয়ালি, কখনও বা গ্রামীণ নাট্যরূপে। এই বহুত্ববাদী পরিবেশ বাংলার সংস্কৃতির ঐক্যের পরিচয় দেয়।
সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির এই মিলন শুধু মাত্র বিনোদনের আয়োজন নয়, বরং এর একটি গভীর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। যেখানে আজকের তরুণ প্রজন্ম নিজেদের শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেখানে এই রকম এক আয়োজন তাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে আত্মপরিচয়ের এক উন্মোচন। ছোট পত্রিকার প্রকাশক ও লেখকরা যেমন তাঁদের সৃজনশীল লেখনী তুলে ধরেছেন পাঠকের হাতে, তেমনি শিল্পীরা তুলে ধরেছেন বাংলার বুকে লুকিয়ে থাকা চিরন্তন সৌন্দর্য।
এই আয়োজন নিঃসন্দেহে বাংলা আকাদেমির এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যেখানে সাহিত্য, শিল্প, সংগীত ও সমাজ এক সুতোয় গাঁথা হয়ে উঠেছে এক সার্বজনীন উৎসবে। আগামী দিনে এই ধারা বজায় থাকুক, আরও বেশি সংখ্যক শিল্পী ও সাহিত্যিক এখানে মিলিত হোন।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/KausikChak1234/status/1908933229006196743?t=gn4a0mG9-yvNvsBn8IBmkQ&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908934259819106638?t=9xcQaEauqd4mXAFbju0nhg&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908938311059578998?t=z_sQqPv8xbgJvhSs0jG7Yg&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908938731580760085?t=dYVV4ig3c85GN1qQpgRGyA&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908938921909883134?t=wzMPhN_b9zSN6RclVAcGcg&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908939138679587089?t=zkF6Z6LlrXE1NBJmLmIYfg&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1908939422558564390?t=FnO3T9DTfuW1khn3TdYNIg&s=19
এও সমস্ত গল্পই আমার জানা। তাও আবার পড়লাম৷ আর খুব মিস করলাম। এই প্রোগ্রামটা আগে থেকে ফিক্স করা থাকলে হয়তো যেতে পারতাম আর ভালোও লাগত। এমন মেলা তো আর সব সময় হয় না। তাও তোমার তোলা ছবিগুলো দেখে চোখ ভরিয়ে নিলাম।
যেকোনো অঞ্চলের সংস্কৃতি সাহিত্য তার ঐতিহ্য প্রমাণ করে থাকে। এখানেও ঠিক এমন টা হয়েছে। এটা শুধু বিনোদনের ব্যাপার না। এখানে রয়েছে একটা সুদীর্ঘ এবং সুন্দর ইতিহাস জীবনযাপন রীতি।।