শিল্পী কিশোর কুমারের জীবন প্রসঙ্গে কিছু মজার ঘটনা।
কিশোর কুমার ও বিভিন্ন রঙ্গতামাশা
🙏 সকলকে স্বাগত জানাই🙏
যদি তারে নাই চিনি গো সেকি-
চিনি, তাঁকে আমরা হৃদয় দিয়ে চিনি, তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বরে চিনি।
আমি চিনিগো চিনি তোমারে... ওগো......
না তিনি 'বিদেশিনী' নন। তিনি ভারতীয়, খাঁটি বাঙালিও। এই রবীন্দ্রগানগুলো শুনে কোন শিল্পীর কণ্ঠ ভেসে আসছে? ঠিকই ধরেছেন, মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া নিবাসী কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ পুত্র আভাষ কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোর কুমার। যে শিল্পীর জীবনের শেষ গাওয়া অমুক্তিপ্রাপ্ত গানটি নিলামে বিক্রি হয় ১৬.৬ লক্ষ টাকায়। আরো শুনবেন? সেরা পুরুষকণ্ঠের জন্য যাঁর ঝুলিতে এসেছিলো আটআটটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, সর্বকালের মধ্যে উক্ত বিভাগে এটিই রেকর্ড। যাঁর স্মরণে মধ্যপ্রদেশ সরকার আজও দিয়ে চলেছে 'কিশোর কুমার স্মৃতি পুরস্কার'।
কিশোর কুমার শুধু একটি নাম নয়, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, সুরের গুরু। গানের সাথে সাথে তাঁর পেশাদারিত্ব, রসিকতা ও মুক্তমনা মনোভাবে একটা সময় বুঁদ হয়ে থাকতো তামাম বলিউড। একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। শিল্পীর ওয়ার্ডেন রোড ফ্ল্যাটে সবসময় টাঙানো
Beware of Kishore
বোর্ড। তাঁর সাথে দেখা করে বকেয়া অর্থ মেটাতে এসেছেন প্রখ্যাত পরিচালক এইচ এস রাওয়াল। কিছুক্ষন ঘন আড্ডার পর হাত মেলাতে গেলেন পরিচালক। হাত তো মেলালেনই না, বরং রাওয়াল এর হাতে বসিয়ে দিলেন জোর কামড়। তারপর অবাক পরিচালক কে দরজার দিকে দেখিয়ে বলেছিলেন বাইরের বোর্ডটি কি দেখে আসেননি? কিশোর কুমার এমনই। তাঁর চকিত রসিকতা ও ভাবগম্ভীর সুর মাধুর্যে মেতে থাকতো আপামর ভারতবাসী।
একসময় বলিউড ও বাংলার টাবলয়েডগুলো পরিবেশন করতো তাকে নিয়ে বহু মুচমুচে সংবাদ। চায়ের টেবিলে তুফান তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল শুধুমাত্র সত্তরের দশকের কিশোর। তাঁর চারটি বিবাহ, ভিন্ন আঙ্গিকের বিবাহ জীবন এবং তাদের পরিসমাপ্তি - সবটা মিলেও কখনো তাঁর কোনো ব্যাক্তিগত কুৎসা গায়ক কিশোরকে ছাপিয়ে উঠতে পারে নি কোনো মুহূর্তে। আজও পঁচিশের যুবক
tere mere milan ki ye rehena
তে কেঁপে উঠতে কার্পণ্য করে না। তবে সকলের জানা যেসব কাহিনী তার মধ্যে অবশ্যই ফেলা যায় তাঁর চারচারটি বিবাহকে। তাই আজ এই রসায়নে বেশি আলো ফেলা শুধুমাত্রই চর্বিতচর্বন ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু অনেকেই হয়তো যেটা জানেন না সেটা বলা যাক, তৎকালীন বলিউড হার্টথ্রব মধুবালাকে যখন বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসেন মধ্যগগনে থাকা স্ময়ং কিশোর, তখন নায়িকা নিজেই ভুগছেন হার্টের অসুখে। এমনকি চিকিৎসার জন্য তখন তাঁকে লন্ডন পাঠাবার ব্যাবস্থাপনা প্রায় পাকা। ১৯৬০ সালে সামাজিক বিবাহের আগে কিশোর ধর্মান্তরিত হয়ে গ্রহণ করেন ইসলাম। নতুন নাম হয় করিম আব্দুল। তাঁর গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার কোনোদিনই এই সিদ্ধান্তে মত দিতে পারেন নি। এমনকি সম্পূর্ণ হিন্দু রীতি মেনে অনুষ্ঠিত হওয়া বিবাহলগ্নেও অনুপস্থিত থাকেন তাঁর বাবা, মা। যদিও এই বহু চর্চিত বিবাহ কখনোই সুখকর হয় নি। বিয়ের মাত্র একমাসের মধ্যেই মধুবালা ছেড়ে যান তাঁকে এবং বান্দ্রায় তাঁর নিজস্ব বাংলোতে স্থানান্তরিত হন।
রসিক কিশোরের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। তখন প্রযোজক-পরিচালক হিসাবে মধ্যগগনে জি. পি. সিপ্পি। তাঁর প্রযোজনায় শোলে, সীতা অউর গীতা তখন বাজার মত্ করছে। সেই সময় তিনি একটি গান রেকর্ডিংয়ের জন্য এলেন কিশোরের কাছে। ঠিক তখনই কিশোর তাঁর গাড়িতে বেরিয়ে যাচ্ছেন বাড়ি থেকে। ডাকলেন প্রযোজক। কিন্তু ফল বিপরীত। গাড়ির আরো গতি বাড়িয়ে ছুট দিলেন শিল্পী। ধাওয়া করলেন সিপ্পিও। উত্তর মুম্বাইয়ে একটি জায়গায় গাড়ি থামাতে বাধ্য করলেন কিশোরকে। কিন্তু কোথায় কি? তাঁকে যেন চিনতেই পারলেন না কিশোর। উল্টে আবার পুলিশের ভয় দেখিয়ে চম্পট দিলেন কোনোরকমে। পরেরদিন স্টুডিওতে ঠিক সময়ে হাজির কিশোর। দেখামাত্রই রেরে করে উঠলেন সিপ্পি। কিন্তু কিশোরের উত্তর চমকে দিলো তাঁকে। তিনি প্রমান করে ছাড়েন যে সিপ্পি একটি স্বপ্নের ঘোরে দেখা ঘটনা বিবৃত করছেন মাত্র। কারণ ঠিক সেই সময় তিনি মুম্বাইতে ছিলেনই না, উপরন্তু ছিলেন মধ্যপ্রদেশে খান্ডোয়ার বাড়িতে। এবার বুঝলেন তো কেন নিজের ফ্ল্যাটে "Beware of Kishore" নোটিশ ঝুলিয়ে রাখতেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা প্লেব্যাক সংগীত সম্রাট?
বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় 'আনন্দ' সিনেমায় চরিত্রায়নের জন্য প্রথম প্রস্তাব দেন কিশোর কুমার এবং মেহমুদকে। অর্থজনিত ভুলবোঝাবুঝির জন্য তিনি সই করতে রাজি না হওয়ায় সরে যান মেহমুদও। তারপর হৃষিকেশ প্রস্তাব দেন সুপারস্টার রাজেশ খান্না ও নবাগত অমিতাভ বচ্চনকে। বাকিটা সবার জানা। এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে কিশোরের নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের দিকটি। সেই যুগের কলাকুশলীরা আজও জানেন নগদ পেমেন্ট হাতে না এলে কিশোরকে গান গাওয়ানো ছিল প্রায় অসম্ভব। সেক্রেটারির কাছে পেমেন্টের নিশ্চয়তা পেলে তবেই তিনি রেকর্ডিংয়ে যেতেন। এই প্রসঙ্গে আরো একটা ঘটনা বলা যাক, 'ভাইভাই' সিনেমার সেটে তিনি শুটিং এর ঠিক আগে বেঁকে বসলেন। পরিচালক এম. ভি. রমনের থেকে তখন বকেয়া প্রায় ৫০০০ টাকা। টেকের সময় তিনি সেট থেকে মেকাপ সমেত বিদায় নিতে দুবার ভাবেন নি। আবার প্রযোজক আর. সি. তলোয়ারের কাছে বকেয়া ৮০০০ টাকা আদায়ের জন্য তিনি রোজ তাঁর বাড়ি গিয়ে চিৎকার করতেন ও বলতেন
Hey Talwar, de de mere aath hazaar
এমনই বহু গল্প শোনা যায় তাঁর পেশাদারিত্বকে নিয়ে। তবে তাঁর "no money, no work" নীতির বাইরে গিয়েও তিনি বহু ফিল্মে গান গেয়েছেন একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে। যদি তিনি পেমেন্ট নেবেন না বলে মনস্থির করতেন, তবে পরিচালক নগদ দিতে এলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করতেন। এমনকি ১৯৬৪ সালে অভিনেতা-প্রযোজক বিপিন গুপ্তাকে তাঁর 'ডাল মে কালা' সিনেমার জন্য নগদ ২০০০০ টাকা দিয়ে সাহায্যও করেন কিশোর। অরুন কুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাগলপুরের বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন তিনি। এরপর আর পেশাদারি কিশোরের মহত্ব বা সামাজিক কর্মনিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একান্তই অবান্তর মনে হতে পারে।
সুরসাম্রাজ্যের এমন সুত্রধরকেও জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু কাটাতে হয়েছিল একাকীত্বের মধ্যে দিয়ে। ১৯৮৫ সালে পৃথ্বীশ নন্দীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিশোর বলছেন তিনি তাঁর বাগানে গাছেদের সাথে কথা বলে দিন কাটান। এমনকি সেযুগের বহু খ্যাতনামা সাংবাদিককে তিনি তাঁর বাগানে নিয়ে যান এবং তাঁর নাম দেওয়া বিভিন্ন গাছেদের দেখিয়ে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করেন।
তিনি আজও বলিউড গান-সাম্রাজ্যের ঈশ্বর। ষাট-সত্তরের দশক একসময় মেতে ছিল একযোগে কিশোর-রফি-লতার সুরমূর্ছনায়। তাঁরা আজও পথ দেখান, আজও দুলিয়ে দেন বর্তমান প্রজন্মকেও। আমরা আজ শিল্পীর জন্মদিনে একযোগে বলতে পারি
mera jiban kora kagaj kora hi rehe gaya
কারণ আজ আর গান শোনান না কিশোর, মাত্র ৫৮ বছর বয়স তাঁকে কেড়ে নিয়েছে তামাম সংগীতপ্রেমী মানুষের বুক থেকে। যদিও শুধু তাঁর অনুপস্থিতিটুকু বাদ দিলে তিনি আজও বেঁচে আছেন শ্রোতার হৃদয়ে, প্রতিটি প্রেমিকের মনে। আজও প্রেমিক হৃদয় প্রেম নিবেদনের আগে আপন মনেই গেয়ে ওঠেন
mere sapno ki rani kab ayegi tu ..
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Daily tasks-
https://x.com/KausikChak1234/status/1878136514733093286?t=6A2dNYxnNaAB1I1YXmN9HA&s=19
বাহ,অনেক কিছু জানতে পারলাম আপনার পোষ্ট পড়ে দাদা।কিশোর কুমারের জীবন প্রসঙ্গে বেশ কিছু ধারণা হলো, যেটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো।আসলেই শিল্পীদের কখনো মৃত্যু হয় না তারা বেঁচে থাকে গানের মাধ্যমে,সুরের মাধ্যমে।ধন্যবাদ দাদা।
আপনি ঠিকই বলেছেন ভাই। শিল্পীরা বেঁচে থাকেন তাদের শিল্পসত্তার মধ্য দিয়ে। আর কিশোর কুমারের মতো শিল্পী এক শতাব্দীতেও বারবার জন্মায় না।
ভাই☺️☺️.
সরি। বোনকে ভাই বলে দিয়েছি৷ হয়ত রিপ্লাইয়ের সময় খেয়াল করিনি বোন 😁
কোনো ব্যাপার না দাদা।
এই বাঙালি কিংবদন্তি শিল্পী চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন উনার গানগুলোর মধ্যে দিয়ে। আমি নিজেই উনার ফ্যান। অনেক গুলো গান আমার অনেক পছন্দের। তবে উনার সম্পর্কে সেরকম কিছুই জানতাম না। আপনার পোস্ট টা পড়ে বেশ মজার এবং ইস্টারেস্টিং কিছু ব্যাপার জানতে পারলাম। ধন্যবাদ ভাই পোস্ট টা শেয়ার করে নেওয়ার জন্য আপনাকে।।
আমিও ওনার দারুন ফ্যান ভাই। আসলে আমার মনে হয় সব বাঙালিই এনার ফ্যান। আর কিশোর কুমার সারা পৃথিবীর কাছে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।