বাংলার রাজ সিংহাসনে সেন বংশের অবদান। একটু ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া।
বাংলার রাজসিংহাসনের সেন বংশের রাজাদের অবদান
🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏
বাংলার ইতিহাস জানতে গেলে যে অধ্যায়ের কথা না বললেই নয় তা হলো সেন বংশের রাজত্বকাল। বাংলার সঙ্গে আজও ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে সেন বংশের রাজাদের নাম। আসলে সেই যুগে হিন্দু সেন রাজারা সুশাসনের মাধ্যমে বাংলায় বসে ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ শাসন করেছিলেন। সেন রাজাদের রাজত্বকাল শুরু হয় আনুমানিক ১০৭০ সাল থেকে। কিন্তু তার বহু পূর্বেই সেন বংশের পুরুষেরা ধীরে ধীরে ছোট ছোট অঞ্চলে রাজত্ব তৈরি করেন। আসলে এর আগে বাংলার রাজত্ব ছিল বিখ্যাত পাল রাজাদের হাতে। যে রাজবংশের সূচনা হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজা গোপালের হাত ধরে। কিন্তু তারপরে ধীরে ধীরে পাল বংশের রাজত্বকালে বিভিন্ন ধরনের অরাজকতা এবং প্রজা বিদ্রোহের কারণে সেন রাজারা তাঁদের রাজত্বের অংশ বাড়াতে শুরু করেন। এইভাবে ধীরে ধীরে সেনদের হাতে একটা সময় ভারতের একটি বৃহৎ অংশ এসে পড়েছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে উত্তর ভারতের কনৌজ থেকে শুরু করে রাজস্থান পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গ তথা বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত সেন রাজাদের রাজত্বাধীন ছিল। সুতরাং বাংলায় বসে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না তাদের পক্ষে। সেন রাজাদের বাংলার মসনদে শেষ হিন্দু রাজত্ব হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আসলে রাজ্য শাসন ধর্মের উপর নির্ভর করে না। কিন্তু যখন একটি ধর্মের রাজা অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে বিমুখ হয়ে পড়েন, তখনই শুরু হয় যাবতীয় বিপত্তি। প্রজাবিদ্রোহের কারণ হিসাবে এই ধরনের কাজগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সেন রাজাদের সময়কালে বাংলা এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বেশ শান্তিপূর্ণই ছিল বলে দেখা যায়। আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে সেন রাজারা একটি ছোট রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই রাজ্যকেই বৃহৎ আকার দিতে শুরু করেন। যার ফলস্বরূপ বল্লাল সেন এবং লক্ষণ সেনের আমলে ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের শাসনাধীন হয়ে যায়।
পাল বংশের কাছ থেকে এই বিশাল রাজত্বের শাসনভার প্রথম লাভ করেন সামন্ত সেন। তাই সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তার নামটিই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলার বর্ধমান অঞ্চলে বসবাস করতেন বলে শোনা যায়। কিন্তু প্রথম সেন বংশের রাজা হলেও তিনি রাজা উপাধি ধারণ করেননি। বরং তার পুত্র হেমন্ত সেন 'মহারাজা' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন এবং সামন্ত সেনের পরে সেন বংশের রাজা হয়ে বাংলার হাল ধরেছিলেন। কিন্তু সেন বংশের সর্বাধিক প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেনের হাত ধরে। তিনি ১০৯৫ থেকে ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার রাজত্বভার সামলেছিলেন। এই দীর্ঘ ৬৩ বছরে তিনি সেন বংশের সীমাকে অনেকটা বৃদ্ধি করেন। রাজধর্ম পালন এবং রাজনীতিতে তার মতো রাজা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। তিনি উড়িষ্যার হিন্দু রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন বাংলার পাশেই থাকা উড়িষ্যা রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকলে কখনোই রাজ্যের সীমাকে বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। বিজয় সেন মিথিলার নান্যদেব, গৌড়রাজ মদন পাল ও কোশাম্বীর সামন্তরাজা দ্বোরপবর্ধনকেও পরাজিত করেছিলেন। ভোজবর্মণকে পরাজিত করে বিজয় সেন পূর্ববঙ্গ জয় করেন। এছাড়া কলিঙ্গ ও মগধের কিছুটাও তিনি জয় করেছিলেন।
সেন বংশের বিজয়গাথাতে তাই এই রাজার নাম গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়। যদিও ইতিহাস তাকে নিয়ে তেমন কিছু কথা বলেনি। কিন্তু বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেন বাংলার রাজ সিংহাসনে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে আজও অমর হয়ে রয়েছেন। সেন বংশের রাজাদের শাসননীতি বিভিন্ন তাম্রলিপি এবং শিলালিপি থেকে জানা যায়। যেমন রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত দেওপাড়া প্রশস্তি অথবা ব্যারাকপুর তাম্রশাসন লিপি থেকে বিজয় সেনের জয়কথা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। সেন বংশের রাজত্বকালে বাংলার প্রজারা ভালো ছিল। তাঁদের নিজস্ব মুদ্রা এবং সংস্কৃতি তখন ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম চর্চার বিষয় হিসাবে উঠে এসেছিল। সেন রাজাদের প্রায় প্রত্যেকেই সংগীত এবং কলায় বিশেষভাবে নিপুণ ছিলেন বলেই জানা যায়।
সেন রাজারা কোথা থেকে বাংলায় এসেছিলেন তা নিয়ে তর্ক বিতর্কের অন্ত নেই। বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেনের নামের সঙ্গে যেহেতু কোন রাজা উপাধি পাওয়া যায় না, তাই ধরে নেওয়া হয় তিনি হয়তো পাল রাজাদের অধীনে কোন উচ্চপদস্থ চাকুরিরত কর্মচারী বা সামন্ত ছিলেন। এবং সেখান থেকেই পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। ঐতিহাসিক হান্টার সাহেব মনে করেন সেন রাজাদের আদিপুরুষ বীরসেন সুদূর অযোধ্যা থেকে বাংলায় এসেছিলেন। যদিও এই মত নিয়েও তর্কবিতর্ক আছে। আসলে প্রায় হাজার বছর আগে একটি বংশের শাসনামলে বাংলার হাল হকিকত জানা অনেকটাই তাম্রলিপি বা শিলালিপির উপর নির্ভরশীল। আর সেই দিক থেকে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় প্রাপ্ত শিলালিপি সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা সামন্ত সেন এবং তার বংশের পরিচয় বহন করে।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1899149760730480969?t=E8LIIBgVewiAFWOQIyH8IA&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Daily tasks-
বাংলার রাজসিংহাসনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পাল ও সেন বংশের রাজত্বকাল। বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের কথা আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি৷ তবে এর বাইরেও অনেক রাজা আছেন যাদের কথা তুমি কী সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছ। খুব ভালো লাগছে পড়ে৷
যে ইতিহাসগুলো সচরাচর পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায় না তার প্রতি আমার আগ্রহ তা তো তুই জানিস। তাই এবার ঠিক করলাম সেন বংশের সেই সব রাজাদের নিয়ে একটু লেখা দরকার। তুই পড়ে সুচিন্তিত মন্তব্য করলি বলে ভীষণ ভালো লাগলো।
সেন বংশ বাংলার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশেষ করে বিজয় সেন ও বল্লাল সেনের শাসনকাল বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির সাক্ষী। তাদের শাসননীতি, সামরিক সাফল্য এবং সামাজিক সংস্কার আজও ইতিহাসের আলোচনার বিষয়।
একদম সঠিক কথা বলে সংযোজন করলেন ভাই। সেন বংশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য আজও ঐতিহাসিকদের গবেষণার একটি অন্যতম বিষয়। আপনার এমন সুন্দর মন্তব্যটি আমার লেখার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিল