বাংলার প্রাচীন জনপদ বিষ্ণুপুর তথা মল্লভূম নিয়ে কিছু কথা।
মল্লভূম বা বিষ্ণুপুর শহরকে নিয়ে দু চার কথা
মল্লভূম। বাংলার উর্বর অঞ্চলের রাজারাজড়াদের নাগালের বাইরে সে এক বিশাল অরন্য অধ্যুষিত স্বাধীন রাজ্য। রাজা আছে, সিপাই আছে, আছে অস্ত্র-শস্ত্র, পাইক, বরকন্দাজ। এমনকি বিখ্যাত কারিগর জগন্নাথ কর্মকারের নিজে হাতে তৈরি কামান। মুর্শিদাবাদের নবাবী নজরের বাইরে সে এক হিন্দুরাজাদের বিচরণভূমি। ভৌগলিক সীমানায় নবাবের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও বিস্তীর্ণ জঙ্গলের কারণে নবাব কখনোই ফিরে তাকাননি এই অঞ্চলের ত্রিসীমানায়। এমনকি নিয়মিত নবাবকে কর দিলেও মুর্শিদাবাদের দরবারে কখনো হাজিরা দিতে হয়নি মল্লভূমের রাজাদের। যদিও একজন প্রতিনিধি রাখা থাকতো নবাবের দরবারে।
যাই হোক, ফেরা যাক ঘটনায়, ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা আদিমল্লের নিজেহাতে প্রতিষ্ঠিত রাজপাট। সেযুগের দুর্ধর্ষ মল্লযোদ্ধা হিসাবে তাঁর দিগ্বিদিক খ্যাতির কারণে মল্লরাজ নামেই লোকে বেশি চিনতে শুরু করে তাঁকে। আর এই মল্লরাজদের হাতেই সযত্নে গড়ে উঠতে থাকে মল্লভূম, আজকের বিষ্ণুপুর। সমগ্র রাজত্বকালের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় ৪৯ তম রাজা হাম্বীর মল্ল দেবের সময়ে। রাজা হাম্বীর মল্ল ছিলেন পরম বৈষ্ণব। সে কথা না হয় পরে কখনো বলা যাবে। শহরের সমস্ত মন্দির ও স্থাপত্যই প্রায় এই হাম্বীর মল্লের সময় ও তার পরে পরে তৈরি। সম্রাট আকবরের সমসাময়িক রাজা হাম্বীর মল্লের শক্তিশালী রাজ্যপাটের কারণে বীর হাম্বীর নামেই লোকে ডাকতো তাঁকে। বাদশা আকবরের সাথে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক। বর্তমানে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট বিষ্ণুপুর রাসমঞ্চ তাঁর হাতেই নির্মিত। তবে রাজা বীর সিংহ, দুর্জন সিংহ (মদনমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা), চৈতন্য সিংহ, রঘুনাথ সিংহের হাতেও তৈরি হয় বিভিন্ন চোখ ধাঁধানো পোড়ামাটির স্থাপত্য ও মন্দির৷ তৎকালীন আশপাশের ঘন জঙ্গল ও দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে বহুদূর থেকে পাথর আমদানি ছিল নিতান্তই খরচাসাপেক্ষ। তাই স্থানীয় লালমাটিতে কারুকাজ করে তা পুড়িয়ে মুর্তি নির্মাণ। এটিই হল টেরাকোটা। শ্যামরায় মন্দির, মদনমোহন মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, জোড়বাংলো, লালজি মন্দির আরো আনাচেকানাচে অজস্র টেরাকোটার স্থাপত্য এর মধ্যে অন্যতম। মন্দিরের গায়ে সুক্ষ্ম রামায়ন মহাভারত এবং মধ্যযুগীয় শিল্পকলা। তাকিয়ে থাকতে হয় অবাক বিস্ময়ে। কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়াই শুধুমাত্র হাতের কাজে দেয়ালগাত্রে পাতলা বাংলা ইটের ভিতের ওপর পোড়ামাটির কাজ। প্রতিটা ইটের ফাঁকে যেন লুকিয়ে আছে কত শত বীরত্ব আর শৌর্যের আখ্যান। কান পাতলে আজও অবিকল শোনা যায় কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর শৈল্পিক আঙুলে নকসা বোনার শব্দ।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1900252053647352053?t=PO3EaEF8CUe5ioTSCEn0mQ&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Daily tasks-