শেষ চিঠি
রাহুল তার দিদার পুরনো বাড়িতে বসে ছিল, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বাক্সগুলোতে তার শৈশবের স্মৃতি বন্দী ছিল। এলাচ আর শুকনো গোলাপের মিষ্টি গন্ধ এখনও বাতাসে ভাসছিল, যেন দিদার উপস্থিতি অনুভব করানো জন্য। সে জানতো, তাকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে, কিন্তু কোনোভাবে নিজেকে সরাতে পারছিল না।
হঠাৎ, পুরনো বই আর বিবর্ণ ছবির ভেতর, সে একটা ছোট কাঠের বাক্স দেখতে পেল। হাত বাড়িয়ে সেটি খুলতেই একটা চিঠি বেরিয়ে এলো— পুরনো কাগজ, সময়ের ছাপ স্পষ্ট।
চিঠির খামের উপর তার পরিচিত হাতের লেখা:
"রাহুলের জন্য, যখন সে প্রস্তুত হবে।"
তার বুক ধক করে উঠলো। তার দিদা সবসময় বলতেন:
"তুমি কখনো এই পৃথিবীতে হারিয়ে যাবে না, যদি তুমি জানো তুমি কে।"
কিন্তু সত্যটা হলো, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। সে অন্য দেশে বড় হয়েছে, ইংরেজিতে কথা বলে, ইংরেজিতে ভাবে, বাংলা তার কাছে অনেক দূরের ভাষা হয়ে গেছে— যেন শৈশবের কোনো গান, যার কথা সে ভুলে গেছে।
কাঁপা হাতে, সে চিঠিটি খুলল।
"আমার প্রিয় ছেলে,
যদি তুমি এই চিঠিটি পড়ো, তাহলে বুঝবো আমি আর তোমার পাশে নেই। কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমার সাথে চিরকাল থাকবে।
আমি এখনও মনে করতে পারি, সেদিন তুমি বলেছিলে: "দিদা, আমার বাংলায় কথা বলতে কষ্ট হয়।" আমি হাসলাম আর বললাম: "আমি অপেক্ষা করবো।" কারণ ভাষা শুধু শব্দ নয়। ভাষা হলো উষ্ণতা, যা আমরা ভাগ করে নিই। ভাষা হলো স্মৃতি, যা আমরা বহন করি। ভাষা হলো সেই ঘর, যেখানে তুমি সবসময় ফিরে আসতে পারবে।
যখন তুমি ছোট ছিলে, আমি তোমাকে বাংলায় গান গেয়ে ঘুম পাড়াতাম। তুমি আমার হাত শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে পড়তে। একদিন তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে:
"দিদা, তুমি সবসময় বাংলায় কথা বলো কেন?"
আমি তোমাকে বলেছিলাম:
"কারণ এটা তোমার হৃদয়ের ভাষা। তুমি যদি কখনো শব্দ ভুলেও যাও, তোমার হৃদয় সবসময় মনে রাখবে।"
আজ হয়তো তুমি ভুলে গেছো। হয়তো তোমার মনে হয় বাংলা তোমার জীবনের অংশ নয়। কিন্তু এটা সত্য নয়। তুমি বাংলা। তুমি সেই গল্প, যা আমি তোমাকে বলেছি। তুমি সেই মিষ্টির স্বাদ, যা তুমি শৈশবে খেয়েছো। তুমি সেই হাসি, যা আমরা ভাগ করে নিয়েছিলাম, যখন তুমি ভুল বাংলায় কথা বলেছিলে।
আমার সোনার ছেলে, তুমি যে দেশেই যাও না কেন, যে ভাষায় কথা বলো না কেন— যদি কখনো মনে হয় তুমি হারিয়ে গেছো, যদি মনে হয় কিছু একটা নেই তোমার জীবনে— কেবল বাংলায় একটা শব্দ বলো।
আর তুমি সাথে সাথেই তোমার ঘর খুঁজে পাবে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি। চিরকাল।
তোমার দিদা।"
রাহুল চোখ বন্ধ করল। তার ভেতরের কিছু একটা যেন নরম হয়ে গেল।
তার কানে ভেসে এলো দিদার কণ্ঠস্বর। তার সামনে যেন স্পষ্ট ভেসে উঠলো— বাড়ির উঠোনে তিনি শাড়ি শুকোতে দিচ্ছেন, আর পুরনো গান গুনগুন করছেন। তার হাতের উষ্ণতা যেন এখনও অনুভব করা যায়, কপালে আলতো ছোঁয়া দিচ্ছেন।
তার শৈশব। তার শিকড়। তার ভাষা।
চোখের জল নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো। হাতের চিঠির ওপর কয়েক ফোঁটা পড়ে গেল।
সে ফোন বের করে মায়ের নম্বর খুঁজল। হাত কাঁপতে কাঁপতে সে লিখল:
"মা, তুমি কেমন আছ?"
এক মুহূর্তের মধ্যেই উত্তর এল:
"আমি ভালো আছি, বাবা। তুমি কেমন?"
রাহুল চোখ বন্ধ করল। মুখে হালকা হাসি ফুটলো।
সে আর হারিয়ে ছিল না। সে তার বাড়ির পথ খুঁজে পেয়েছে।