Nobel Peace Prize Winner Country Is Now The Forerunner Of Unrest!
Image: Ethiopia Meeting Conference Source
বিশ্বের যে দেশটি সবচেয়ে জনবহুল ল্যান্ডলকড কান্ট্রি (landlocked Country) হিসেবে পরিচিত এবং কখনো সম্পূর্ণ কলোনিতে পরিনত হয়নি, সে দেশটির নাম ইথিওপীয়া। হর্ন অব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়াতে চলমান "সরকার বনাম তাইগ্রে" গৃহযুদ্ধটা খুবই জটিল একটা বিষয়। তারপরেও খুব সহজ করে পুরো বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করবো। আপনি যদি কোন দেশের সরকারব্যবস্থা এবং ডমিন্যান্ট রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন, পলিসি ও আইডিওলজির প্যাটার্নটা ধরতে পারেন তাহলে ঐদেশের রাজনীতি বুঝতে পারা আপনার জন্য খুবই সহজ।
ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হচ্ছে Ethiopian People's Revolutionary Democratic Front, যাকে সংক্ষেপে "EPRDF" বলে। এই রাজনৈতিক দলটির কাঠামো না বুঝলে আপনি ইথিওপিয়ার বর্তমানে চলমান ক্রাইসিসের রুট কারনগুলা বুঝতেই পারবেন না। ইথিওপিয়ার এই প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলটি নিচের চারটি দলের সমন্বয়ে (Coalition) গঠিত ছিলো।
১) ইথিওপিয়ার উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ি অঞ্চলটি হচ্ছে তাইগ্রে। ইথিওপিয়া- ইরিত্রিয়া সীমান্তের মাঝখানে এই তাইগ্রে অঞ্চলটি। এই তাইগ্রেরা ইথিওপিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর ৬.১% এবং এই তাইগ্রে জনগনের প্রতিনিধিত্বকারী দল- Tigray People's Liberation Front ,যা TPLF নামে পরিচিত।
২) ইথিওপিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হলো আমহারা। ইথিওপিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর ২৭.১%। এই আমহারাদের প্রতিনিধিত্বকারী দল হচ্ছে- Amhara Democratic Party (ADP),
৩) ইথিওপিয়ার সবচেয়ে বড়ো জনগোষ্ঠী হচ্ছে অরমো ভাষাভাষী জনগন। মোট জনগোষ্ঠীর ৩৪.৬%, এদের প্রতিনিধিত্বকারী দল- Oromo Democratic Party (ODP),
৪) ইথিওপিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের মোট ৪৫ টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত আধা স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল রয়েছে।এই অঞ্চলটি "Southern Nation" নামে পরিচিত। এদের প্রতিনিধিত্বকারী দল- Southern Ethiopian People's Democratic Movement (SEPDM)
এবার আসি সরকারব্যবস্থায়ঃ
ক) ইথিওপিয়া একটি ফেডারেল সংসদীয় প্রজাতন্ত্র। রাষ্ট্রের প্রধান হলেন প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্টের হাতে তেমন ক্ষমতা নেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সালেহ জেইদি (ইথিওপিয়ার প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি), সরকার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী, তার হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আবি আহমেদ। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী এই দুটি পদ ছাড়াও ইথিওপিয়ার সংবিধানে "Deputy Prime Minister" এই পদটিও রয়েছে। এই পদটি Vice president পদটির মতোই।তাই এটাকে Vice Prime Minister ও বলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার প্রধানমন্ত্রীর কাজগুলো করে থাকেন। আমাদের কবি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ মৃত্যুর পূর্বে তাকে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের পদটি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে এই পদটি নেই।ইথিওপিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো কয়েকটা দেশে এই পদটি রয়েছে।
খ) Ethnofederalism - এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ টার্ম। ইথিওপিয়া মোট দশটি ফেডারেল অঞ্চলে বিভক্ত। এই অঞ্চলগুলা আধা স্বায়ত্তশাসিত এবং তাদের নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্সও রয়েছে। এই অঞ্চলগুলা বিভক্ত করা হয়েছে ইথনিক জনগোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে।তাই নিজ নিজ অঞ্চলে নিজেদের গোষ্ঠীপ্রধানরাই অঞ্চলগুলো শাসন করে। ফরেন পলিসি, সিকিউরিটি, মুদ্রা ব্যবস্থা এই তিনটি কেন্দ্রীয় সরকার (প্রধানমন্ত্রী) নিয়ন্ত্রণ করে, আর বাকিসব ফেডারেল গভর্নরের হাতে।
গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার সবকিছুতেই হস্তক্ষেপ করে থাকে। ভারত, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল স্টেটগুলা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জিওগ্রাফির উপর ভিত্তি করে ভাগ করা তাই এদেরকে "Federalism" বলে কিন্তু ইথিওপিয়ার স্টেটগুলা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে বলে এটাকে "Ethnofederalism" বলে।
ঐ চারটি দলের সমন্বয়ে গঠিত এই EPRFD দলটি ২৭ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকলেও এই চারটি দলের বাকি তিনটি দল থেকে ঘুরেফিরে প্রধানমন্ত্রী হয়েছে কিন্তু Oromo Democratic Party থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেনি। কিন্তু ২০১৮ সালে এন্টি গভার্নমেন্ট আন্দোলনের তোপে হেলমেরিয়াম প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করলে আবি আহমেদ Oromo Democratic Party থেকে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ক্ষমতায় এসে আবি আহমেদ রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্করণ করার চেষ্টা করেন। এই সংস্করণ থেকেই তাইগ্রে এর সাথে আবি আহমেদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
আবি আহমেদ ও তাইগ্রে নেতাদের মধ্যে আসলে দ্বন্দ্বের কারনগুলো কি কি?
১) সংস্করণের মধ্যে একটা ছিলো যে, Ethiopian People's Revolutionary Democratic Front (EPRDF) এই সমন্বিত দলটি ভেঙে দেওয়া। দেশে মোট ৮০ টির বেশি ভিন্ন জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী থাকলেও EPRDF এই দলটি অল্পকয়েকটি কমিউনিটির সমন্বয়ে গঠিত।এই দলটি ২৭ বছর ক্ষমতায় থেকে দেশকে একদলীয় সরকার ব্যবস্থায় পরিনত করেছে। তাই এই সময়টাকে আবি আহমেদ "27 years of darkness" হিসেবে উল্লেখ করেন এবং গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এই সমন্বিত দলটি ভেঙে দিয়ে দেশের সকল আদিবাসী ও ইথনিক জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে "Prosperity Party" নামে নতুন একটি দল গঠন করেন। অন্য সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তাতে সারা দিলেও তাইগ্রে জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী দল "Tigray People's Liberation Front (TPLF)" তাতে সারা দেয়নি এবং আবি আহমেদের এই সমন্বিত জোট থেকে তাইগ্রেরা বের হয়ে যায়।
২) দেশ থেকে দূর্নীতি নির্মুল করতে আবি আহমেদ প্রশাসন অনেক দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে তাইগ্রে জনগোষ্ঠীরও অনেক নেতা ছিলো। তাই তারা মনে করে যে সরকার তাদেরকে দমন করার জন্য দূর্নীতি নির্মূলের নামে তাদের গ্রেপ্তার করেছে।
৩) পূর্বে দীর্ঘদিন ধরে তাইগ্রেরা রাষ্ট্রের চার্চ, মিলিটারি চিফ ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসলে তারা তাদের সেই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো হারান। তাই তাইগ্রে এর রাজনীতিবিদরা আবি আহমেদকে এন্টি-তাইগ্রে হিসেবে উল্লেখ করেন।
৪) করোনার প্রকোপ ঠেকাতে আবি আহমেদ এর কেন্দ্রীয় সরকার সব ধরনের প্রাদেশিক নির্বাচন স্থগিত করলেও তাইগ্রেতে গত বছরের ২১শে আগস্ট প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাইগ্রে স্টেটের এই নির্বাচনে তাইগ্রেদের প্রতিনিধিত্বকারী Tigray People's Liberation Front (TPLF) এই দলটি ১০০% ভোট পেয়ে জয়লাভ করে। আবি আহমেদ এই নির্বাচনকে বয়কট করেন এবং TPLF কে অবৈধ ঘোষণা করেন।
৫) ১৯৬১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ইথিওপিয়া- ইরিত্রিয়া এই দুটি দেশ একসাথে ছিলো।ইরিত্রিয়া অঞ্চলে কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মাধ্যমে গণ-আন্দোলন হলে ১৯৯৩ সালে ইথিওপিয়া থেকে ইরিত্রিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। তারপর ১৯৯৮ সালে পুনরায় ইথিয়পীয়া- ইরিত্রিয়া যুদ্ধ বাঁধলে ২০০০ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হলেও সীমান্তে সংঘাত চলতেই থাকে। তারপর আবি আহমেদ ক্ষমতায় এসে ২০১৯ সালে ইরিত্রিয়ার সাথে শান্তি চুক্তির করে দীর্ঘদিনের সংঘাত বন্ধ করেন এবং শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পান। কিন্তু ইরিত্রিয়ার সাথে আবি আহমেদের এই শান্তি চুক্তি মেনে নিতে নারাজ তাইগ্রে এর নেতারা। যেহুতো ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার ঠিক মাঝখানে তাইগ্রে অঞ্চলটি তাই তাইগ্রে এর নেতারা মনে করছে দুটি দেশ মিলে তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা করার চেষ্টা করছে।
৬) তাইগ্রে অঞ্চলে তাইগ্রে জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও স্বল্পসংখ্যক আমহারা ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীও ছিলো। কিন্তু তাইগ্রেরা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের কারনে তাইগ্রে অঞ্চলের আমহারাদের নির্বিচারে গণহত্যা করে এবং সর্বশেষ গত চার নভেম্বর TPLF এর সামরিক বাহিনী হঠাৎ ফেডারেল সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করলে আবি আহমেদ পাল্টা আক্রমণের নির্দেশ দিলে টিপিএলএফ ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। রক্তাক্ত এই সংঘাতের কারনে হাজার হাজার মানুষ ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজাট মানুষ শরনার্থী হয়ে সুদানে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘ বলছে এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে শরনার্থীর সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়াবে।
ইথিওপীয়ার রাজনীতিতে টিপিএলএফ কিভাবে এলো?
ইথিওপীয়াতে ১৯৭৪ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে পতন হয় রাজা হেইলে সেলাসির। ক্ষমতা দখল করে নেন দ্য ডের্গ নামের এক সামরিক জান্তা। সামরিক বাহিনী তখন অনেক তরুণকে হত্যা করে। পরের বছরই ডের্গ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে টিপিএলএফ। সেই থেকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। টিপিএলএফ ও দ্য ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইপিআরডিএফ) যৌথ হামলায় ১৯৯১ সালে সামরিক সরকারের পতন হয়। এরপর ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে টাইগ্রের আঞ্চলিক দল টিপিএলএফ।ইপিআরডিএফ ক্ষমতা থাকে ২৭ বছর, সে সময় দুর্ভিক্ষ বিদায় নেয় এবং শিশুমৃত্যুর হার কমে যায় বড় আকারের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে । কিন্তু বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবি ও তার অনুসারীরা একে বলেন ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ২৭ বছর’।
যেভাবে পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ এই গৃহ যুদ্ধকে আরো জটিল করে তুলবে?
গতবছর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও, আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ অনেক দেশ সরকার ও টিপিএলএফের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের সমঝোতার কথা বললে আবি আহমেদ বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে অস্বীকৃতি জানান। দেশের অভ্যন্তরীন সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবেন বলে জানান। কিন্তু সেই সমাধান আর হচ্ছে না বরং সহিংসতা বেড়েই চলছে। সম্প্রতি ইথিওপিয়া নীল নদের উপর গ্র্যানন্ড রেনেসাঁস ড্যাম নির্মান করে যা নিয়ে মিশর ও সুদানের সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধে।(গ্র্যান্ড রেনেসাঁস ড্যাম নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমার টাইমলাইনে ২২ নাম্বার পোস্টটা পড়তে পারেন)। ধারনা করা হচ্ছে তাইগ্রে ইস্যুতে সুদান ও মিশর তাইগ্রে নেতাদের সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে আবার চায়না ইথিওপিয়াতে উন্নয়ন মূলক অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, ফলস্বরূপ আবি আহমেদের সাথে চায়নার সম্পর্ক ভালোই। তাই চায়না বিরোধীরা তাইগ্রে ইস্যু নিয়ে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করলে এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী রুপ নিবে। সুযোগ নিবে অনেক জঙ্গি গোষ্ঠী। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ল্যান্ডলক এই দেশটি এবং যে দেশটি কখনো সম্পূর্ণ কলোনিতে পরিনত হয়নি, সে দেশটির বর্তমানে চলমান সংঘাত উসকে দিবে আল শাবাবের মতো আঞ্চলিক জঙ্গি গোষ্ঠী গুলোকেও।
আপনারা জেনে থাকবেন যে, বাংলাদেশের ডিবিএল নামের একটা কোম্পানী ইথিওপিয়ার ট্রাইগ্রে অঞ্চলে একটি পোশাক কারখানা চালু করেছিলো ২০১৮ সালে। এই শ্রমিকরা সেখানেই কর্মরত ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই লড়াই তীব্র হয়ে যাওয়ায় এই শ্রমিকদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কলমে: মুহাম্মদ মিরাজ মিয়া ভাই
https://twitter.com/JannateeHur/status/1379638976642838529