এলোমেলো ভাবনা
এক মেয়ে তার বাবাকে খুব ভালোবাসতো। বাবাকে ব্যবসার কাজে দূরে যেতে হয়েছে। যাবার আগে মেয়েকে অনেক আদর করে গেছে। বলে গেছে,ফিরতে দেরি হবে। ফিরবার আগে যেন মেয়ে তাকে না খোঁজে। খুঁজলে যারা কাজ দিয়েছে,তারা অনেক রাগ করবে। বাবা চলে গেল। মেয়েটা দিন রাত কাঁদে বাবাকে না পেয়ে। শেষে থাকতে না পেরে বাবার কাজের জায়গায় চলে গেল,বাবার নিষেধ সত্ত্বেও। ছোট্ট মেয়ে, বাবার নিষেধ কি কারণে ছিল,বোঝেনি। বাবা তখন অনেক পালটে গেছে। মেয়েকে ঠিকমত দেখতেও পারলো না। কিসের একটা যন্ত্রণা, বাবাটার মুখের সব কথা কেড়ে নিয়েছে। মেয়েকে বারবার ফিরে যেতে অনুরোধ করে। ছোট্ট মেয়ে কি আর এত বোঝে? বাবাকে ছুঁতে না পেরে তার কেবল কান্না আর কান্না। শেষে বাবা কোনমতে মেয়েকে বুঝিয়ে বাসায় ফেরত পাঠালো। দুইদিন পরে মেয়েটা জানতে পারলো,বাবাটার অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাবাকে যারা কাজ দিয়েছিল,তারা মেয়েটা আসাতে অনেক রাগ করেছে। বাবার কাজ পিছিয়ে গেছে। শেষ করতে, বাড়ি ফিরতে বাবার এখন আরো বেশি সময় লাগবে। বাবার অফিসের দারোয়ানটা মেয়েটাকে জানালো, "তোমাকে তোমার বাবা এত মানা করলো,তবু কেন তুমি আসলে? তোমার জন্য তোমার বাবা এখন কাজে এতখানি পিছিয়ে গেলো। তোমার বাবার কাজ শেষ হবার আগে যদি আরেকটাবার তোমাকে এই জায়গার ত্রিসীমানায় দেখি,তোমার বাবাকে আর দেখতে পাবে না তুমি। যাও ভাগো। তোমার বাবা তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই জায়গার কেউ তোমাকে ভালোবাসে না। তোমার বাবাকে আটকে রাখতে আমাদের কিচ্ছু যাবে আসবে না। আর তুমি এখন কান্নাকাটি করে যদি আমাদের মন গলিয়ে বাবাকে নিয়ে যেতে চাও, লাভ নেই। আমরা ছোট বাচ্চার কান্নাকে দাম দেই না। মানবিকতা আমরা বুঝি না। কেঁদে কেঁদে মরে যাও। সময় শেষ হবার আগে বাবাকে পাবে না।" মেয়েটা এসব কথা শুনে আর লোকটার সামনে কাঁদেনি। আস্তে আস্তে ফিরে চলে আসে বাসাতে। এসে চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে রাতে সে বাবার একটা জামা গায়ের মধ্যে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছিল। প্রথম কথাটা তার মনে পড়েছিল, বাবা নেই পাশে। দূরের কোন দেশে আছে। এখন সে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলেও তাকে আদর করে ঘুম পাড়াবার কেউ নেই। এখন তার নিত্যদিনের রুটিন, ঘুম থেকে উঠে, সে পড়ে, খায়,খেলে, ঘুমায়। আর বন্ধুদের সাথে গল্প করে। বন্ধুরা জানে না,মেয়েটার বাবা মেয়েটার কাছে নেই। দূরে আছে, মেয়েটা এখন তাই আকুল হয়ে বাবার ফেরার অপেক্ষা করে। রাত জেগে বাইরের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে,বাবাটাও কি আকাশ দেখছে? আকাশের চাঁদটাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে? বাবাটা তার মেয়েটাকে কখনো কড়া গলায় কথা বলেনি। দারোয়ানটা মেয়েটাকে অনেক ধমকে কথা বলেছে। মেয়েটা না,তখন শুনে একটুও কাঁদেনি। কাঁদেনি এই ভয়ে যে,কাঁদলে যদি দারোয়ানটা বাবাকে আটকে ফেলে সারাজীবনের জন্য? এর মধ্যে মেয়েটার একবার জ্বর এসেছিল। দারোয়ানটাকে খবর পাঠানো হয়েছিল,মেয়েটার অনেক জ্বর। একটু সময়ের জন্য বাবাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বাবা মেয়েকে দেখে, একটু আদর করে চলে যাবে। মেয়েটা বাবাকে অনেক খুঁজছে। দারোয়ানটা কি নিষ্ঠুর! বাবাকে আসতে দিলো না। বলল, অসুখের চিকিৎসার জন্য অন্য লোক আছে। বাবাকে লাগবে কেন? চিকিৎসা করালে মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। এখন যদি মেয়েটা আর একটা বার বাবাকে খোঁজ করে,বাবাকে আর কখনো দেখবে না মেয়েটা। তবে যদি মেয়েটা এখন ভালোভাবে সেরে উঠে,বাবা যা বলে গেছে,তা মেনে চলে,তবে বাবা ফিরে আসবে কাজ শেষে। মেয়েটা সেদিন থেকে কান্না কমিয়ে দিয়েছে। আগে মেয়েটা অনেক অবাধ্য ছিল। মিথ্যা বলতো, ঢং করতো। কারোর কথা শুনতো না। সবাইকে খালি মরে যাবার হুমকি দিতো। খেতো না ঠিকমত। এখন তার সব পালটে গেছে। বাবা তাকে বলে গেছে,নিজের যত্ন নিতে। সে এখন ঠিকমত খায়, সবার কথা শুনে, একফোঁটা মিথ্যা বলে না। ঢং আহ্লাদ কিচ্ছু নেই। আর মরার হুমকি দেয় না কাউকে। বাবাকে অনেক ভালোবাসে যে? বাবার অপেক্ষায় আছে তো... কাজ শেষ করে কবে তার বাবা ফিরে আসবে,তাকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করবে। মেয়েকে ছেড়ে আর কোত্থাও যাবে না। আর ওই দুষ্টু দারোয়ানটাকেও অনেক বকে দেবে,যাতে আর জীবনেও মেয়ের সাথে কথা বলতে না আসে। মেয়েটা ছোট হলেও বোঝে,বাবারও অনেক কষ্ট হয় মেয়েকে ছাড়া থাকতে। মেয়েটা যে একটা মুহূর্তও বাবার কাছছাড়া হতে চাইতো না, বাবারও তো বুক খালি হয়ে আছে। মেয়েকে কোলে নিতে না পেরে বাবাও তো রাত গভীর হলে, কেউ আশেপাশে না থাকলে নীরবে চোখ মোছে। দুই প্রান্তে দুই আত্মা, বাবা আর মেয়ে, অপেক্ষায় আছে,অপেক্ষা শেষ হবার জন্য। কবে বাবাটা মেয়েকে কোলে তুলে নেবে? মেয়েটা এখন দিন গোনে....