আমাদের বন, আমাদের ভবিষ্যৎ: বন সংরক্ষণে করণীয়

in #environmentyesterday (edited)

ভূমিকা

বন শুধুমাত্র বৃক্ষজমাট এলাকা নয়, বরং পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের বিশাল ভাণ্ডার; প্রচলিত হিসাবে বলা হয় স্থলভাগের প্রায় ৮০% প্রাণীর জীবনবৈচিত্র্যই বনাঞ্চলে বাস করে। বন মানুষে জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত; বিশ্বজুড়ে প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ খাদ্য বা জ্বালানীর জন্য বনভূমি নির্ভর এবং কোটি কোটি মানুষ বনভিত্তিক কর্মসংস্থানে অবলম্বিত। বন অক্সিজেন উৎপাদন করে, জলচক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের খাদ্য, পানিসম্পদ ও জীবিকা নিশ্চিত করে। এছাড়া, বনসমূহ বৃহৎ পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন কমাতে সহায়তা করে; উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী বনসমূহ বছরে আনুমানিক ৭.৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক নিঃসরণের প্রায় ১.৫ গুণ।

তবে গত কয়েক দশকে বন উজান বিপজ্জনক হারে বেড়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে গোটা বিশ্বে অন্তত ৪২০ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল হারিয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উজানের হার কিছুটা কমেছে, তবুও ২০১৫-২০ সালের মধ্যে বছরে গড়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশেও বন ভাঙনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়; দেশের মোট ভূমির মাত্র ১৪.১% বনভূমি (২০২০)। এ অবস্থায় বন সংরক্ষণ ও বনায়ন আমাদের কাছে জরুরি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বনগুলির গুরুত্ব

বন আমাদের পরিবেশ ও জীবনের জন্য বহু দিক দিয়ে অপরিহার্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দিক নিম্নরূপ:

জীববৈচিত্র্য রক্ষা: বনভূমি পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল; প্রচলিত হিসাবে স্থলভাগের প্রায় ৮০% প্রাণী-প্রজাতি বনাঞ্চলে আবাস করে।

মানুষের জীবিকা: বন কোটি কোটি মানুষকে অক্সিজেন, পানি, খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ করে। ১.৬ বিলিয়ন মানুষ বনভূমির ওপর খাদ্য ও জ্বালানীর জন্য নির্ভরশীল।

মাটি ও জলবায়ু: বন মাটি ক্ষয় ও ভূমিধস রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনজ মাটিতে জমাটবদ্ধ শেকড় মাটি ধরে রাখে, বন্যা-প্রলয়ের ঝুঁকি কমায় ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

কার্বন সঞ্চয়: বনসমূহ বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, ফলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বের বনসমূহ প্রতিবছর আনুমানিক ৭.৬ বিলিয়ন মেট্রিক টন CO₂ শোষণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক নিঃসরণের প্রায় ১.৫ গুণ।

বন উজান ও হুমকি

বন উজান এবং অবক্ষয়ের প্রধান কারণসমূহের মধ্যে আছে:

কৃষি সম্প্রসারণ: খাদ্য ও পশুপালনের জন্য অতিরিক্ত ভূমি তৈরিতে বন উজানো হয়।

অবকাঠামো উন্নয়ন: সড়ক, বাঁধ, শহর ও শিল্পায়নে বনাঞ্চল কাটা হচ্ছে।

অবৈধ কাঠকাটা ও বনভূমি দখল: পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়া বন থেকে অবৈধ কাঠ আহরণ এবং বনাঞ্চল দখলে রাখার কারণে বন সংকট বাড়ছে।

অপরিকল্পিত পশুপালন ও চারাগ্রাস: অতিরিক্ত পশুপালন এবং খামারের জন্য বনভূমি ব্যবহার বনজ জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট করে।

দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন: চক্রবাত, দাবদাহ, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাবে বিশেষ করে উপকূলীয় বনাঞ্চল (যেমন সুন্দরবন) ঝুঁকির মুখে পড়ছে।

এসব হুমকির মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বনজ সম্পদ নাশ হতে থাকবে।

বন সংরক্ষণ কৌশল

বন উজান রোধ এবং বন বৃদ্ধি করতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারি, যেমন:

বনায়ন ও পুনর্বনায়ন: বনাঞ্চল বাড়ানোর অন্যতম উপায় হল খালি বা উজান হওয়া জমিতে নতুন করে গাছ লাগানো। বন কর্তনের পর ক্ষতস্থানে চারা রোপণ করে বনচক্রের টেকসইতা বাড়ানো যায়।

নির্বাচিত কর্তন: নির্দিষ্ট গাছ চিহ্নিত করে কাটা এবং অপর গাছ অক্ষত রাখলে পুরো বনভূমি ধ্বংস ঠেকানো যায় (Selective logging)।

সামাজিক বনায়ন: আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণকে জড়িয়ে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি চালালে দ্রুত বনায়ন বৃদ্ধি সম্ভব।

আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা: বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি বনাঞ্চল দখল-অবৈধ কটাইনিরোধে কঠোর নজরদারি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

প্রযুক্তি ও গবেষণা: স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ, ড্রোন সার্ভেইল্যান্সের মাধ্যমে বনাঞ্চলের অবস্থান মনিটর করে অবৈধ কর্মকাণ্ড শনাক্ত করতে হবে। পাশাপাশি গাছের রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন পদ্ধতি উন্নয়নে গবেষণা করা যেতে পারে।

সরকারের ও নাগরিকদের ভূমিকা

সরকার এবং সাধারণ মানুষ উভয়েরই বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে:

নীতিমালা ও পরিকল্পনা (সরকার): বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে গাছের আচ্ছাদন ২৫% এবং বনভূমি ১৬% করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ‘মরুপ্রান্তর, মাটি ক্ষয় ও খরার বিরুদ্ধে জাতীয় কর্মসূচি’ গ্রহণ ও জাতিসংঘের SDG-১৫ (জীবনধারণ) অনুযায়ী ‘ভূমি অবক্ষয় নিরপেক্ষতা’ অর্জনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

বনায়ন উদ্যোগ (সরকার): সামাজিক বনায়ন ও বনায়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ চলছে; ২০০৯-২৩ সালের মধ্যে প্রায় ২১৭,৪০২ হেক্টর নতুন বনায়ন এবং ১১২ মিলিয়ন চারা রোপণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক মরসুমে ৮৩.৩৩ মিলিয়ন চারা রোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুদ্ধার (সরকার): বনভূমি দখলমুক্ত করতে সরকার বিশেষ কর্মসূচি নিয়েছে; ২০২০-২৪ সালের মধ্যে আনুমানিক ৩০,০০০ একর বনভূমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বনে পানি সরবরাহ ও সামুদ্রিক আগ্নেয়গিরির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ বাড়ানো হয়েছে।

নাগরিক অংশগ্রহণ ও সচেতনতা: সকল নাগরিককে পরিবেশ শিক্ষার মাধ্যমে বন সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে। বিদ্যালয়-কলেজ ও গণমাধ্যমে বনজ পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা চালু করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষ নিজের জায়গায় গাছ লাগানো, বনবনভূমি রক্ষায় সহায়তা করা ও অবৈধ কাঠকাটার খবর প্রশাসনকে জানানো ইত্যাদির মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে।

উপসংহার

বন আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। একদিকে গ্লোবাল উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, অন্যদিকে নদীবাঁধ-প্রশস্তি ও ফসলের উর্বরতা বজায় রাখতে বন অপরিহার্য। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বন সংরক্ষণে সফল হতে পারি। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন রক্ষা করতে পারলে আগামী প্রজন্ম সবুজ জীবন উপভোগ করবে এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। বন সংরক্ষণ এখন সবার প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।