Story of life : নিমন্ত্রণ
“ হ্যাঁ গো, দশটা বাজল । এবারে কি হারুর মা কে ভাত বসাতে বলব ? “ – চাটুজ্যে গিন্নী বললেন । সমরেশ বাবু একটা মোটা খাতাতে কিছু হিসেব করছিলেন ।
মুখ না তুলেই বললেন – “কেন ? আজ তো হরিপ্রসাদের ভাই দুটির পৈতে । নেমন্তন্ন আছে তো ! “
“ সেটাই তো বলছি । দশটা তো বাজল । কই , নেমন্তন্ন তো ক'রে গেল না ! কোন সকালে গোটা গাঁয়ের নেমন্তন্ন সারা । এমন কি হারুর মা দেরও নেমন্তন্ন করেছে । আমাদের ঘরে তো আসে নি । “
স্ত্রী এর মুখে একথা শুনে সমরেশ বাবুর কলম থেমে গেল । তিনি মুখ তুলে তাকালেন । এক অবাক বিস্ময়ের ভাব ।
সমরেশ চাটুজ্যে , আমাদের গ্রামের মোট জমি-জায়গার, পুকুর-পুষ্করিণীর প্রায় অর্ধেকের মালিক । তাছাড়াও, আশেপাশের গ্রামেও তাঁর মালিকানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । তিনি শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিশীল । পাশাপাশি বিশটা গ্রামের লোক চাটুজ্যে বলতে তাঁকেই বোঝে ।হরিপ্রসাদ চাটুজ্যে তাঁরই জ্ঞাতি , সম্পর্কে ভ্রাতুষ্পুত্র । সমরেশ বাবুর তুলনায় তিনি যথেষ্ট নিম্নবিত্ত ও স্বল্পখ্যাত । আজ তার ই দুই ভাই এর পৈতের দিন । সাড়ম্বরে পৈতের অনুষ্ঠান হচ্ছে । সকাল থেকেই সানাইয়ের সুর গ্রামের কোনায় কোনায় জানান দিচ্ছে সেই দ্বিজ হওয়ার বার্তাটি । গ্রামের অনেকের সপরিবার নিমন্ত্রণ । আবার কোন কোন পরিবারের একজন ।
সমরেশ বাবু একবার ভাবলেন জ্ঞাতি-সুলভ ঈর্ষার কারনেই কি তাঁকে নিমন্ত্রণ করে নি হরিপ্রসাদ ? একটুক্ষন থমকে গেলেন তিনি । স্ত্রী এর দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
“ বল, কী করব ? হারুর মা তাড়াহুড়ো করছে । ভাত বসাতে বলি ?” চাটুজ্যে গিন্নীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ।
- “ একটু দাঁড়াও । আমি আসছি । “ -সমরেশ বাবু কাঁধে চাদরটা ফেলে ঘরের কোনে থাকা তাঁর সৌখিন লাঠিটি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ।
- চাটুজ্যে গিন্নী বাইরে এসে হারুর মা কে বললেন – “ দাঁড়াও, বাছা, একটু । “
- “ খুড়িমা , আমি তাইলে ঘর থিকে একটু ঘুরে আসি । দেখি হারুর বাপ গাঁ ঘুরে এল কি না । “ -হারুর মা বলল ।
- “ এক্ষুনি চলে এস কিন্তু । “চাটুজ্যে গিন্নী পানের বাটাটা নিয়ে বসলেন ।
হারুরা বৈষ্ণব । হারুর বাবা কীর্ত্তন করে পাশাপাশি দু’চারটে গ্রাম ঘুরে ভিক্ষে করে । হারুর মা চাটুজ্যে বাড়িতে রান্নার কাজ করে । বছর বারোর হারু তাদের একমাত্র সন্তান । তিন জনের সংসার কোনমতে চলে যায় । ক্ষেত খাল বিলের শাক , ভিক্ষেতে পাওয়া দু'একটা আলু বেগুন – এই সব দিয়ে প্রতিদিনের খাওয়া দাওয়া ।
আজ হারুর মা খুব খুশি । বড় ঘরের ভোজ । গ্রামের একমাত্র বৈষ্ণব পরিবার বলে তাদের হয়তো সপরিবার নিমন্ত্রণ । যাইহোক, আজ দুটো ভালো-মন্দ খেতে পাবে ছেলেটা । হারু তো সকাল থেকেই লাফালাফি করছে । চুঁয়ো-পোড়া মুড়ি গুলো জল ঢেলে খেতে খেতে হারু বলছিল – “ মা, ছোট দিকেও দু'টা মাছ দিবেক ? ক'টা মিষ্টি , মা ? “
সমরেশ বাবু , হরিপ্রসাদের বাড়ির সামনে । নহবত গেট । তার ওপর বসে এলাকার বিখ্যাত সানাই বাদক । চারিদিকে সুরের মূর্ছনা । অনেক আত্মীয় স্বজন , হৈ হুল্লোড় , হাসি মস্করা । কেউ কেউ অতি ব্যাস্ত ।
" আতপ চাল কোথায়? " - কেউ জিজ্ঞেস করছে। কেউ আর একজন চীৎকার করে বলছে - " রাঁধুনি ঠাকুর এক টিন সরষের তেল চাইল।"
হরিপ্রসাদ ঘরের উঠোনে একটি চেয়ারে বসে দু-একজন কর্মী কে কিছু বলছিলেন ।
সমরেশ বাবু সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন – “ হরিপ্রসাদ । “
একবার তাকিয়েই হরিপ্রসাদ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল – “ কাকাবাবু ! আসুন , আসুন । “
সমরেশ বাবু দু'এক পা ভেতরে এসেই বললেন – “ তোমার তো দুই ভায়ের পৈতে আজ । তা , তুমি কি আমাকে নেমন্তন্ন করতে ভুলে গেছ , না, ইচ্ছে করে কর নি ? “
হরিপ্রসাদ চমকে উঠলো । একটুক্ষন নির্বাক । পরক্ষণেই তাঁর পায়ের কাছে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ।
“ আরে , কর কি , কর কি ! ওঠো । “ – সমরেশ বাবু ঝুঁকে পড়ে তাকে ওঠালেন ।
হরিপ্রসাদ হাত জোড় ক’রে বলল – “ আমি হয়তো নিজে যেতে পারি নি । গগন খুড়োই তো গ্রামের নেমন্তন্ন টা করে । আমি তাকে আপনার বাড়িতেই প্রথম যেতে বলেছিলাম । “ পরক্ষণেই সে উত্তেজিত কন্ঠে চিৎকার ক’রে উঠলো – “ গগন খুড়ো ! গগন খুড়ো ! “
সমরেশ বাবু হেসে বললেন – “ থাক্ , থাক্ । সময় তো পেরিয়ে যায় নি । তোমার কাকিমা বলছিলেন ভাত বসাবেন কি না । তো , আমি বললাম , দাঁড়াও , আমি একটু একটু ঘুরে আসি । আমি তো জানি , নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হয়েছে । আমাকে তো তুমি নেমন্তন্ন না করা হবে না ।“
বাড়ির সকলের চোখ এই মহানুভব ব্যাক্তির দিকে ।
হরিপ্রসাদ সানুনয়ে বলল – “ কাকাবাবু , একটু মিষ্টি জল খেয়ে যান । “
সমরেশ বাবু হেসে বললেন – “ না হে , দুপুরে খাব । যাই , না হলে তোমার কাকিমা আবার ভাত বসিয়ে ফেলবে । “
অনুষ্ঠান বাড়ির সকলকে বিমূঢ় ক’রে সমরেশ বাবু বেরিয়ে গেলেন ।
হারুর সবচেয়ে ভালো জামাটার বগলের কাছ টা ছেঁড়া । তার মা সেটা সেলাই করতে করতে বলল - “ এটা প'রে বেশি লাফালাফি করিস না । আবার ছিঁড়ে যাবে ।“
হারুর বাবা তার বিয়ের পাঞ্জাবি টা বের করল । কোন ভোজ কাজেই এটা বেরোয় । হারুর মা চাটুজ্যে গিন্নীর দেওয়া একটা পুরানো শাড়ি পরল । সেই দুপুর বারোটা থেকেই হারু লাফাচ্ছে – “ও মা, চল । সবাই চলে গেল । “
“ শুন , খাব খাবই ভাল । খেয়ে লিলেই ত শেষ । “ – তার বাবা বোঝাল । একটু পরে তারা তিন জনে বেরোলো । সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে । এক টুকু পথ , তাও যেন শেষ হতে চায় না । হারুর মনে হচ্ছিল এক ছুট্টে চলে যায় । রাস্তায় বুধা মাজির সাথে দেখা – “ তোদের নিমন্তন্ন আছে ? বাব্বা ! এ হারু ,ভালো ক’রে খাবি , বাপ । মরা পেটে আবার সইলে হয় !”
হারু দুরের থেকেই গন্ধ পাচ্ছিল । ভোজের একটা আলাদা গন্ধ থাকে ।
এই বছরখানেক আগে রামগতি মুখুজ্জ্যের শ্রাদ্ধে হারুদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেদিন দুপুরে কি সুন্দর খেয়েছিল সে! আর তারপরে, সেদিন রাত্রি পর্যন্ত হাতটা শুঁকছিল বারবার। ভোজের গন্ধ। রাত্রে ভাত খাওয়ার সময়ও গন্ধটা ছিল। আলু সেদ্ধ দিয়ে ফ্যান ভাত খাওয়ার সময় মা কে বলেছিল - " মা, এখনও হাতে ভোজের গন্ধ রয়েচে, -- মনে হচ্ছে, ভোজ খাচ্ছি।"
প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়াল ওরা । অনেক লোক । এবারে একটুও জায়গা নেই । হারুর বাবা বলল – “ দাঁড়া , পরের বারে বসব । “
হারু মাঝে মাঝেই প্যান্ডেলের গেটে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে । একবার এসে বলল –“ মা , দু’টা করে মাছ দিচ্ছে !”
মা ফিসফিস করে বলল – “ চুপ ! “ ছেলের হ্যাংলাপনা যাতে অন্য লোকে শুনতে না পায় ।
আবার একটু পরেই হারু উঁকি দিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল – “ মা , রসগোল্লা পান্তুয়া দু’টাই আছে । “
হরিপ্রসাদের ভগ্নিপতি কলকাতা থেকে এসেছেন । তিনিই তদারকি করছেন । ফর্সা রঙ , সুন্দর পাঞ্জাবি । হাতের আঙুলে অনেক গুলো সোনার আংটি । তাই সবসময় আঙুল মেলে ধরে কথা বলছেন। হরিহর মুখুজ্জ্যে আর শিবদাস রায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন - " মিষ্টি তো সব বাড়িতে বানানো। আরও দুটো করে খান না। এই ভাই, এখানে আরও মিষ্টি দিয়ে যাও তো।"
প্যান্ডেল ফাঁকা হতেই ছুট্টে গিয়ে হারু একটা জায়গায় বসল । তারপরেই বাবা মা কে ইশারা ক’রে ডাকছে । মুখে অস্ফুট আওয়াজ - " মা, এস। ও মা এস গো! "
“ অ্যাই ছোঁড়া , ওঠ , ওঠ । আগে নিমন্ত্রিতরা খাবে । প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়া । “ – সেই সুন্দর পাঞ্জাবি হারুকে টেনে তুললো ।
হারুর চোখ ঝাপসা । আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে মায়ের দিকে ।
সেই ভদ্রলোক অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছেন – “ গ্রামের এই এক ব্যাপার । আরে , আমার সাতশো নিমন্ত্রিত । আগে তো তাদের খাওয়াতে হবে ! আমাদের কলকাতায়……… “ সেই সময় সমরেশ বাবু এলেন। তাঁকে দেখতে পেয়েই তিনি বললেন - "আসুন, আসুন কাকাবাবু। এইখানে বসুন - আমি জায়গা রেখেছি। "
কেউ একজন ভোজ খেয়ে বেরিয়ে বলছে, -" দাঁত খোঁচার কাঠি চাই হে। পাকা মাছ ছিল তো। দাঁতের ফাঁকে ঢুকে গেছে। "
হারুর মা ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বলল – “ চ বাবা , গরম গরম ভাত ক’রে দেব । “ মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে হারু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । সানাইয়ে তখন রাগ – টোড়ী ।