শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি - মনের গভীরের কথাগুলো লেখা আর সুরে বাঁধা
আসসালামু আলাইকুম
কেমন আছেন সবাই? আশা করবো সবাই ভালো আছেন সৃষ্টিকর্তার রহমতে । আমিও আছি আপনাদের দোয়ার বরকতে জীবন নিয়ে ভালোই। দিন যায় কথা থাকে। দিন কিন্তু সত্যি সত্যি চলেই যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে সময়। সময় কখন আসে আর কখনই বা যায় সেটা টেরই পাই না। তাই ব্যস্ততার পরিমানও দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। আজকাল যেন জীবনের সাথে যুদ্ধ করেই জীবন পার করতে হচ্ছে। তবুও সময় করে বসে পড়লাম আপনাদের জন্য একটু লেখালেখি করার জন্য। আমি আশা করি আজকের ব্লগ আপনাদের সবার অনেক বেশি ভালো লাগবে। সব সময় চেষ্টা করি ভালো ভালো ব্লগগুলো আপনাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য।

AI Tools দিয়ে কভার ফটো তৈরি করা হয়েছে
প্রতিটি মানুষের জীবনে ছেলেবেলা হলো একটি স্বর্ণযুগ। আমরা কেউ কিন্তু আমাদের ছেলেবেলাকে ভুলতে পারি না।জীবনের প্রতিটি পদে পদে আমাদের কাছে আমাদের ছেলেবেলা ধরা দেয় স্মৃতি হয়ে। ছেলেবেলার সেই আনন্দঘন দিনগুলো আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে মধুর স্মৃতি বিলিয়ে দেয়। নিয়ে যায় সেই শৈশবের কিছু সুন্দর মূহূর্তে। যেখান থেকে ফিরে আসাটাই বেশ মুশকিল। তবুও আমরা ফিরে আসি। আমাদের কে ফিরে আসতে হয়। তাই তো আজ আমি আবার চলে আসলাম আপনাদের মাঝে আমার সেই ছেলেবেলার আরও কিছু স্মৃতি ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য।
ছেলেবেলা মানেই যেন এক রঙিন সময়, যখন মনটা ছিল খোলা আকাশের মতো, চিন্তা ছিল পাখির মতো মুক্ত। আমার সেই ছেলেবেলার দুটি অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিল—গান গাওয়া আর ডায়েরি লেখা। এই দুটি শখ শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম ছিল না, বরং ছিল আমার আত্মার আরামদায়ক আশ্রয়, মনের কথা বলার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পথ। সরকারি কোয়ার্টারের ছোট্ট ঘরে বসেই আমার সৃষ্টিশীলতার যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাইরে খেলাধুলা আর দুরন্তপনার মাঝেও আমার নিজের জন্য তৈরি হয়েছিল এক নিভৃত জগৎ, যেখানে আমি গান গেয়ে আর ডায়েরি লিখে নিজের সমস্ত অনুভূতিকে রঙ ও শব্দে সাজিয়ে তুলতাম।
প্রতিদিন বিকেল হলেই কোয়ার্টারের উঠানে বা ঘরের কোণায় বসে গান গাইতাম। কখনো একা, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে মিলে। সেই সময়টুকু ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠান থাকলে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে প্রস্তুতি নিতাম। গান বাছাই, বারবার রিহার্সাল করা, বন্ধুদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নতুন নতুন সুর তোলা—সবকিছু ছিল অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। আমি লোকগান, আধুনিক গান, জাতীয় সংগীত সবকিছুতেই আগ্রহী ছিলাম। গান শুধু বিনোদন ছিল না, গান ছিল আমার আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। কোনো দিন মন খারাপ থাকলে গানই ছিল সেই ওষুধ, যা আমাকে সান্ত্বনা দিত।
আমার গানের প্রতি ভালোবাসার অন্যতম কারণ ছিল আমার বাবা-মায়ের উৎসাহ। তারা কখনো আমার কণ্ঠস্বর নিয়ে ব্যঙ্গ করেননি, বরং সবসময় উৎসাহ দিতেন। মা প্রায়ই বলতেন, “তোমার গলার মধ্যে একটা আলাদা আবেগ আছে।” বাবা স্কুলে গিয়ে আমার গান শোনার জন্য সময় বের করতেন। তারা চাইতেন আমি এই অভ্যাস ধরে রাখি। আর এই ভালোবাসা থেকেই আমি স্কুলের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, পুরস্কারও পেতাম। সেইসব পুরস্কার ছিল আমার কাছে স্বীকৃতির মতো, যা আমাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।
গান যেমন ছিল সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপার, ডায়েরি লেখা ছিল ঠিক উল্টো—একান্ত আমার নিজের। প্রতিদিন রাতে আমি আমার প্রিয় ডায়েরি খুলতাম। সেখানে লিখতাম কী ঘটল সারাদিন, কার সঙ্গে কী কথা হলো, কোথায় খারাপ লাগল বা কোথায় একটু বেশি ভালো লাগল। অনেক সময় শুধু কয়েকটি লাইনেই সব কথা বলে দিতাম, আবার কোনো দিন পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে আবেগের বন্যা বইয়ে দিতাম। সেই ডায়েরি ছিল আমার নিভৃত বন্ধু, যে কোনো বিচার করত না, শুধু মন খুলে শুনত।
স্কুলে যদি কারো সঙ্গে মনোমালিন্য হতো, আমি কাঁদতাম না, চিৎকার করতাম না, বরং রাতে ডায়েরির পাতায় লিখে ফেলতাম সব। লেখার শেষে এক ধরনের শান্তি পেতাম। সেই শান্তিটা আজও অনুভব করতে পারি। সময় বদলেছে, আমি বড় হয়েছি, কিন্তু সেই ডায়েরির পাতাগুলো আজও যখন পড়ি, মনে হয় আমি সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আবার সেই ছোটবেলার ঘরে ফিরে গিয়েছি।
আমার ডায়েরিগুলোর পাতায় শুধু বাস্তব জীবনের গল্প ছিল না, ছিল কল্পনার ডানা মেলে লেখা কবিতা, ছোট গল্প, কিংবা নিজের লেখা গান। অনেক সময় গান লিখে নিজেই সুর দিতাম। সে এক ভিন্ন রকম আনন্দ। কেউ জানত না আমি কী লিখছি, কিংবা কেমন গান গাইছি—তবে আমি জানতাম আমার মন কতটা শান্ত, কতটা পরিপূর্ণ। ডায়েরি আর গান—এই দুটি শখ আমার জীবনের প্রাথমিক পাঠশালা। এখান থেকেই আমি শিখেছি আবেগ কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, অনুভূতির ভাষা কীভাবে রূপ দিতে হয়। যখন ক্লাসে কোনো রচনার বিষয় আসত, আমি সহজেই লিখে ফেলতাম। শিক্ষকরা বলতেন, “তোমার লেখায় অনেক আবেগ আছে।” হয়তো জানতেন না, সেই আবেগ জন্ম নিয়েছে আমার প্রতিদিনের ডায়েরি লেখার অভ্যাস থেকে।
এই অভ্যাসগুলো আমার জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। শুধু ছোটবেলাতেই নয়, বড় হয়েও আমি বিভিন্ন লেখালেখিতে যুক্ত ছিলাম। গান হয়তো এখন প্রতিদিন গাওয়া হয় না, কিন্তু গানের প্রতি ভালোবাসা আজও রয়ে গেছে। কোনো সময় চুপচাপ বসে থাকলে মনে হয় একটা সুর গেয়ে ফেলি, আর মনের ভার হালকা হয়ে যায়। আর ডায়েরি লেখা এখন হয়তো ডিজিটাল ডায়েরিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু অভ্যাসটা রয়ে গেছে। একসময় আমার বন্ধুরা জিজ্ঞেস করত, “তুমি কীভাবে এত শান্ত থাকতে পারো?” আমি হেসে বলতাম, “আমি সব কথা আমার ডায়েরিকে বলি আর গানকে শুনাই।” এই নির্ভরযোগ্য দুজন সঙ্গী আমার জীবনের পথচলায় আমাকে অনেক সময় সাহস, শক্তি আর ভরসা দিয়েছে।
আজ যখন স্মৃতির জানালায় উঁকি দিই, তখন দেখি সেই ছোট্ট আমি—গলায় সুরের ঝঙ্কার আর হাতে কলম ধরে বসে আছে। কখনো গাইছে প্রিয় গান, কখনো লিখছে মনের গহীনের কথা। সেই আমি আজও আমার ভেতরে বেঁচে আছে। শুধু বয়স বেড়েছে, কিন্তু সেই আবেগ আর ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। এই গল্পটি শুধুই আমার না, বরং এমন অনেকের, যারা ছোটবেলায় কোনো না কোনো সৃষ্টিশীল অভ্যাসকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কেউ আঁকতে ভালোবাসত, কেউ কবিতা লিখত, কেউ গান গাইত। এসব অভ্যাস শুধু সময় কাটানোর উপায় নয়, বরং মনের বিকাশের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে, যখন শিশুরা মোবাইল-ট্যাবলেটের দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে, তখন এই গল্প হয়তো অনেককে মনে করিয়ে দেবে—একটা খাতা আর একটা কলম, কিংবা একটা সুরেলা গলা কতটা বদলে দিতে পারে একটা শিশুর মনন ও ভবিষ্যৎ। গান আর ডায়েরি শুধু শখ নয়, তা হয়ে উঠতে পারে একেকটা জীবনের ভিত্তি। এই অভ্যাসগুলো আমায় শিখিয়েছে কিভাবে নিজের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কিভাবে অনুভূতি বোঝা যায় এবং কিভাবে অন্যের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে হয়। সেই শিক্ষা আমার জীবনের প্রতিটি স্তরে কাজে এসেছে—বন্ধুত্বে, পারিবারিক সম্পর্কে, এমনকি পেশাগত জীবনেও। শৈশবের এই অমূল্য অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি গর্বিত। আমি কৃতজ্ঞ সেই সময়ের প্রতি, আমার মা-বাবার প্রতি, যারা কখনো আমাকে থামিয়ে দেয়নি। বরং ছোট্ট এক খাতা আর একটি গান গাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, যাতে আমি নিজেকে খুঁজে পেতে পারি।
আজও আমি মাঝে মাঝে গান গাই, কিংবা ডায়েরির পাতায় কিছু লিখে রাখি। হয়তো সেই সুরে নেই আগের ঝংকার, লেখায় নেই আগের আবেগের তোড়, কিন্তু মনে হয়—আমি আবার সেই ছোট্ট আমি হয়ে গেছি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, আমার ছেলেবেলার সেই গান আর ডায়েরি লেখা—আজও আমার অন্তরের এক প্রিয়তম কোণ জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে।
জানিনা কেমন লাগলো আমার আজকের টপিকটি। আশা করি আপনাদের কাছে আজকের পোষ্টটি বেশ ভালা লাগলো। ভালো থাকবেন, সুখে থাকবেন। আর নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করবেন।
আমার পরিচিতি
আমি মাকসুদা আক্তার। স্টিমিট প্লাটফর্মে আমি @maksudakawsar হিসাবে পরিচিত। ঢাকা হতে আমি আমার বাংলা ব্লগের সাথে যুক্ত আছি। আমি একজন গৃহিনী এবং চাকরিজীবী। তারপরও আমি ভালোবাসি আমার মাতৃভাষা বাংলায় নিজের মনের কথা গুলো আমার বাংলা ব্লগের প্লাটফর্মে শেয়ার করতে। আমি ভালোবাসি গান শুনতে এবং গাইতে। আমি অবসর সময়ে ভ্রমন করতে এবং সেই সাথে সুন্দর কিছু ফটোগ্রাফি নিজের ক্যামেরায় বন্দী করতে ও ভালোবাসি। মাঝে মাঝে নিজের মনের আবেগ দিয়ে দু চার লাইন কবিতা লিখতে কিন্তু আমার বেশ ভালোই লাগে। সর্বোপরি আমি ভালোবাসি আমার প্রাণপ্রিয় মাকে।
.gif)
VOTE @bangla.witness as witness
OR
SET @rme as your proxy
