ছেলেবেলা আর ঝোলাভাতি খেলার স্মৃতি
আসসালামু আলাইকুম
কেমন আছেন আমার প্রিয় সহযাত্রী ভাই বোনেরা? আশা করি সবাই আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছেন। আমিও আপনাদের সবার দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তবে মনমানসিকতা ভালো নেই। আর মনমানসিকতা যদি ভালো না থাকে তাহলে শরীর মন অচল হয়ে পড়ে। তারপরেও আপনাদের সবার মাঝে আমার আরও একটি পোস্ট নিয়ে হাজির হলাম। আজ আমি একটি শৈশবের কিছু কথা নিয়ে আপনাদের সবার মাঝে হাজির হয়েছি।আশা করি আপনাদের সবার কাছে অনেক ভালো লাগবে। তাহলে চলুন আজ আমার শৈশবের কিছু স্মৃতির অনুভূতি জেনে আসি।

শৈশবের দিনগুলো মনে পড়লেই হৃদয় ভরে ওঠে এক অদ্ভুত আনন্দে। কত ছোট ছোট স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমাদের ছেলেবেলায় ছিল এক বিশেষ খেলা যার নাম জলাভাতি। তখনকার দিনে এই খেলাটা আমাদের কাছে শুধু খেলা ছিল না বরং ছিল বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরও শক্ত করে তোলার এক অদ্ভুত উপলক্ষ। আজ এত বছর পর যখনই মনে করি তখন মনে হয় কী অপার আনন্দের ছিল সেই সময়গুলো।
জলাভাতি শুরু হতো পরিকল্পনার মাধ্যমে। আগের দিন বা সকালে ঠিক করা হতো আজ বিকেলে মাঠে বসে রান্না হবে। এরপর শুরু হতো দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া। কারও ঘর থেকে চাল আনার কথা হতো, কেউ আলু আনত, কেউ ডিম, কেউ কাঁচা মরিচ আর পেয়াজ আনত, আর কারও দায়িত্ব হতো তেল নিয়ে আসা। কখনও কখনও যখন একটু টাকা জমা করা যেত তখন সিদ্ধান্ত হতো আজ মুরগি রান্না হবে অথবা বড়সড় মাছ আনা হবে। সবার সামান্য অবদান মিলেই তৈরি হতো আমাদের রাজকীয় আয়োজন।
সরকারি কোয়ার্টারের বিশাল মাঠই ছিল আমাদের রান্নাঘর। কোন এক নিরিবিলি কোণায় সবাই মিলে লাড়কি জোগাড় করতাম, তারপর ইট জোড়া দিয়ে চুলা বানানো হতো। কেউ কাঠ ভাঙত, কেউ লাড়কি সাজাত, কেউ আগুন ধরাত। তারপর শুরু হতো রান্না। রান্নার সময় চারপাশে ছড়িয়ে যেত ধোঁয়ার কুয়াশা, চোখ ভিজে যেত ধোঁয়ায় আর রোদের তাপে শরীর ঘেমে উঠত, মুখ কালো হয়ে যেত। কিন্তু আমরা হেসেই কাটিয়ে দিতাম সব কষ্ট, কারণ আমাদের মনে থাকত শুধুই আনন্দ আর একসাথে খাওয়ার প্রতীক্ষা।
কতবার যে ডাল বেশি লবণ দিয়ে নষ্ট করেছি তার হিসাব নেই, কখনও ভাত আধা সেদ্ধ হয়েছে, কখনও মাছ পুড়ে গেছে। কিন্তু এসব ভুলত্রুটি নিয়েই আমাদের রান্না ছিল সেরা। রান্না শেষে যখন সবাই একসাথে বসতাম তখন কেবল খাবার নয়, সেই মুহূর্তটাই হয়ে উঠত সবচেয়ে বড় আনন্দ। একজনের গামলা থেকে অন্যজন হাত বাড়িয়ে খাবার নিত, কেউ কারও মুখে খাবার তুলে দিত, আবার কেউ কেউ চুপচাপ ভাত চেপে খেত। সেদিনের সেই ভাত আর তরকারি হয়তো আজকের দামী কোনো হোটেলের খাবারের সঙ্গে তুলনা করা যায় না, কিন্তু তৃপ্তি আর আনন্দের দিক দিয়ে তা ছিল অনন্য।
আমরা শুধু নিজেদের জন্যই রান্না করতাম না, মাঝে মাঝে এমনও হতো আশপাশে যারা খেলতে আসত তাদেরও ডেকে খাওয়াতাম। সবাই মিলে যতটুকু ছিল তা ভাগাভাগি করে খেতাম। তখন মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ আমরা। সেই নিরহঙ্কার ভাগাভাগির আনন্দ আজও হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে। অবশ্য এসব করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের বাসায় খবর পৌঁছে যেত। মা শুনতেন আমি আবার জলাভাতি খেলতে গেছি। তারপরই শুরু হতো বকাঝকা আর কখনও মারও খেতে হতো। মা বলতেন এত খাবার ঘরেই আছে, বাইরে গিয়ে কেন ধুলোবালি মিশিয়ে খেতে হবে। কিন্তু তখনকার আমাদের কাছে ঘরের খাবার কখনও এত মজার মনে হতো না, যতটা আনন্দ দিত বন্ধুদের সাথে মিলে খাওয়া। তাই মার খাওয়ার ভয় থাকলেও সুযোগ পেলেই আমরা আবার জুটে যেতাম মাঠে।
শুধু রান্না নয়, রান্নার সময়কার গল্পগুজবও ছিল অসাধারণ। কে কেমন রান্না পারে তা নিয়ে হাসাহাসি চলত, কেউ কেউ আবার নতুন রেসিপি আবিষ্কারের চেষ্টা করত। রান্না শেষ হলে মাটির উপর ছাতা পেতে বা মাঠের ঘাসে বসে খাওয়া চলত। সেই সময় আকাশে যখন সূর্যাস্তের রঙ ছড়িয়ে যেত, পাখিরা ফিরত বাসায়, তখন আমাদের হাসি আর খাওয়া মিলেমিশে এক অপূর্ব পরিবেশ তৈরি করত। আজকের দিনে যখন চারপাশে এত আধুনিক সুবিধা আছে, তখনো মনে হয় সেই দিনগুলোই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। এখন রেস্টুরেন্টে গিয়ে যত দামী খাবারই খাই না কেন, সেই স্বাদ আর আনন্দ কখনও ফিরে আসে না। কারণ সেই খাবারে বন্ধুত্বের হাসি নেই, একসাথে কাঠ কুড়ানোর পরিশ্রম নেই, রান্নার ধোঁয়ায় চোখ ভিজে যাওয়া নেই। জলাভাতির প্রতিটি কণায় যে বন্ধুত্ব আর মমতা মিশে ছিল সেটাই ছিল তার আসল স্বাদ।
আমরা যত বড় হচ্ছি, তত ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। সবাই আলাদা আলাদা জীবনে জড়িয়ে গেছে। এখন আর কেউ বলে না চাল আনবে কে, ডিম আনবে কে, বা কে আগুন ধরাবে। কিন্তু মাঝে মাঝে মন ভীষণ চায় আবার সেই দিনগুলোয় ফিরে যেতে। আবার একদিন মাঠের কোণে ইট সাজিয়ে লাড়কি জ্বালিয়ে সবাই মিলে রান্না করতে। আবার একসাথে বসে ধুলো মাখা হাতেই ভাত চেপে খেতে। স্মৃতি কখনও হারিয়ে যায় না, শুধু সময়ের সাথে চাপা পড়ে থাকে। আজ যখন লিখছি তখন মনে হচ্ছে যেন আবার সেই দিনগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কানে ভেসে আসছে বন্ধুদের হাসির শব্দ, চোখে ভেসে আসছে ধোঁয়ার কুয়াশা, আর হৃদয়ে ভেসে উঠছে ভাগাভাগি করে খাওয়ার সুখ। হয়তো আর কখনও সম্ভব হবে না ঠিক সেইভাবে জলাভাতি খেলা, কিন্তু স্মৃতির পাতায় তা থাকবে চিরকাল। শৈশবের সেই আনন্দময় দিনগুলোই আমাদের জীবনের আসল সম্পদ। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন সেই স্মৃতিগুলোই আমাদের শক্তি হয়ে থাকবে।
কেমন লেগেছে আপনাদের সবার কাছে আজ আমার শৈশবে ফেলে আসা সুন্দর কিছু স্মৃতি নিয়ে পোস্টটি। আশা করছি আপনাদের সবার কাছে আমার পোস্টটি পড়েও অনেক ভালো লেগেছে সবাই ভালো ও সুস্থ থাকবেন সে পর্যন্ত আগামীতে আবার নতুন ব্লগ নিয়ে আপনাদের মাঝে চলে আসবো ইনশাল্লাহ আল্লাহাফেজ।
আমার পরিচিতি
আমার পরিচিতি
আমি মাহফুজা আক্তার নীলা। আমার ইউজার নাম @mahfuzanila। আমি একজন বাংলাদেশী ইউজার। আমি স্টিমিট প্লাটফর্মে যোগদান করি ২০২২ সালের মার্চ মাসে। আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিতে যোগদান করে আমি অনেক বিষয় শিখেছি। আগামীতে আরও ভালো কিছু শেখার ইচ্ছে আছে। আমি পছন্দ করি ভ্রমন করতে, ছবি আঁকতে, বিভিন্ন ধরনের মজার মাজার গল্পের বই পড়তে, ফটোগ্রাফি করতে, ডাই প্রজেক্ট বানাতে ও আর্ট করতে। এছাড়াও আমি বেশী পছন্দ করি মজার রেসিপি করতে। মন খারাপ থাকলে গান শুননি। তবে সব কিছুর পাশাপাশি আমি ঘুমাতে কিন্তু একটু বেশীই পছন্দ করি।
