আমরা ছিলাম পাঁচজন, আমি, হৃদয়, রাকিব, শাওন আর বাবু। কলেজের শেষ বর্ষ, শেষ ছুটির দিনগুলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা পাহাড়ে ঘুরতে যাবো। জায়গাটা ছিল বান্দরবানের রুমা বাজার, আর সেখান থেকে গিয়ে উঠবো বগালেকের পথে। পাহাড় ডাকছে, আর আমাদের মাথায় তখন শুধু দুটো জিনিস আনন্দ মজা আর ফটোগ্রাফি করা।বাসে উঠতেই শুরু হলো আনন্দ। শাওন কানে হেডফোন গুঁজে নিয়ে গান শুনছে, রাকিব জানালার পাশে বসে ঝিমুচ্ছে, হৃদয় চিপসে কামড় দিয়ে সিনেমার গল্প বলছে, আর বাবু… সে ব্যাগ থেকে খাওয়ার জিনিস বের করে পুরো বাসে হাহাকার সৃষ্টি করেছে। আমি ব্যাগে রাখা ডায়েরি খুলে লিখছি, ভ্রমণের শুরুটা যদি এমন হয়, শেষটা কী হবে আল্লাহই জানে!

বাজার থেকে আমরা ট্রেকিং শুরু করলাম। গাইড ছিল না, কারণ বাবু বলেছিল, ইউটিউব দেখে সব শিখছি ভাই, গাইড লাগে না। দুই ঘণ্টা হাঁটার পর বুঝলাম, ইউটিউব গাইড আর বাস্তব গাইড এক জিনিস না। আমরা পথ হারিয়েছি। চারপাশে শুধু গাছ আর পাখির ডাক। হঠাৎ একটা বনমুরগি সামনেই উড়ে গেল, আর রাকিব বলে উঠল,ভাই, এটা কী মুরগির জাত? পাখির মতো উড়ে গেল যে!

আমরা শেষমেশ একটা ঝিরিপথ ধরে বগালেকের দিকেই এগোতে থাকলাম। সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। মোবাইলের আলো আর বাবুর কল্পনা, ভয়ংকর এক কম্বিনেশন। সে বলছে, ভাই, এই রকম জায়গায় জ্বিন থাকে। গতবার তো এক লোক বলেছিল… এর মাঝেই ঝোপের ভেতর কিছু একটা শব্দ করল। পাঁচজন একসাথে থেমে গেলাম। কেউ নড়ছে না। হঠাৎ হৃদয় বলল, ভাই, আমি দৌড় দিবো! এরপর আমরা সবাই পিছে না তাকিয়ে দৌড়!

কিছুক্ষণ পরেই একটা ঝর্ণার পাশে পৌঁছালাম। এক স্থানীয় লোকের কাঠের ঘর ছিল ওখানে। উনি আমাদের দেখে একটু হেসে বললেন, পথ হারাইছো না?আমরা যেন সেই হাসির মধ্যেই শান্তি খুঁজে পেলাম।পরদিন সকালে আমরা আবার রওনা দিলাম, লোকটা দিক দেখিয়ে দিলেন। দুপুর নাগাদ আমরা পৌঁছালাম বগালেকে। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন আকাশ ছুঁতে পারি। নীল জল, ঠাণ্ডা হাওয়া, আর পাহাড়ের কোলে সেই একটুকরো স্বর্গ।

আমরা জুতা খুলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম লেকের ধারে।শাওন গিটার বের করে গান ধরল –আকাশের ওই নীলে আমার স্বপ্ন ডুবে যায়...বাবু তখনো ভাবছে, এখানে যদি ফুচকার দোকান থাকতো!আমি আর হৃদয় চুপচাপ বসে রোদ মাখছি, আর রাকিব গাছের ছায়ায় শুয়ে বলছে,ভাই, এমন জায়গায় প্রেম করলে জীবনই বদলে যাইতো!

ফেরার দিন সকালে আমরা লেকের পাড়ে একটা মেয়ের ছবি তুলছিলাম, দূর থেকে। সে হঠাৎ ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, তার চোখে যেন পাহাড়ের গল্প। শাওন মুখে ফিসফিস করল,ভাই, পাহাড়ে প্রেম হইছে মনে হয়!শেষ পর্যন্ত আমরা ফিরলাম। কাদা মাখা পা, রোদে পোড়া গাল, মোবাইলে শত শত ছবি আর মনের ভেতরে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে।