২০০২ সালে ঘর ছেড়েছি।।
বাংলা ভাষায় নিজের অনুভূতি তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ-
আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। পাশের বাড়ির রাকিবার সাথে আমি প্রথম গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে গিয়েছিলাম। আমাদের গ্রামের প্রাইমারীর স্কুলটা আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দুরে নয়। হেঁটে গেলে দশ মিনিটের মত সময় লাগবে। আর ছোট সময় যখন স্কুলে যেতাম তখন আধা ঘন্টা পয়তাল্লিশ মিনিটের উপরে সময় লাগতো। তখন স্কুলে যাওয়ার সময় এক বাড়ির বরই গাছে ডিল দিতাম, এক বাড়ির আম গাছের নিচে আম কুড়িয়ে নিয়ে যেতাম। একজন না আসলে তার জন্য রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতাম। তখন পড়াশোনা থেকে অন্য দিকে মনযোগ বেশি ছিল। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কুলে গিয়ে ভবনের ভিতরে কোন রুমে আমাদের জায়গা হতো না। কারন আমাদের নাম স্কুলের খাতায় তালিকা ভুক্ত হয়নি। বাবা গ্রামের বাজার থেকে অ,আ,ই,ঈ লেখা পাঁচ টাকা দিয়ে একটি বই কিনে দিয়েছিল। সেটা নিয়েই স্কুলে যেতাম। আমার মত যাদের নাম স্কুলের হাজিরা খাতায় তালিকা ভুক্ত করা হয়নি তারা সবাই স্কুলের পূর্ব পাশে ল্যান্ডি কড়ই গাছের নিচে বসে থাকতাম। আমাদের দিকে স্কুলের টিচার ম্যাডামের তেমন গুরুত্ব ছিল না। জাষ্ট সবার সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। মা বলতো স্কুলে গেলে আসলেই নাকি অভ্যাস হবে।
এক বছর এভাবে যাওয়া আসার পরে আমাকে আর রাকিবাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে নিলো। মানে আমাদের নাম স্কুলের হাজিরা খাতায় তালিকা ভুক্ত করা হলো। রাকিবার রোল ছিল ৩৭ আর আমার রোল ছিল ৩৮। সরকারি স্কুল তাই ভর্তি হতে কোন টাকা পয়সা লাগে নাই। আমাদেরকে বাংলা অংঙ্ক ইংরেজি তিনটি করে বই দিলো। তিনটি বই দিয়ে স্কুলে জীবনে পা রাখলাম। স্টুডেন্ট হিসাবে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। গরীব ফেমিলিতে জন্ম নেওয়ার কারনে প্রাইভেট পড়তে পারি নাই। তবে ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত কোন বিষয়ে ফেল করি নাই। অংঙ্ক ইংরেজিতে নাম্বার কিছুটা কম পেতাম,তবে প্রতি বছরই পাশ করে পাচঁ বছরে প্রাইমারী স্কুল জীবন শেষ করে ফেললাম। ক্লাশ ফাইভের পরিক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার আগেই আমাকে গ্রামের কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেওয়া হলো। আমাদের গ্রামে টাইটেল পর্যন্ত বিশাল বড়ই একটি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় যেতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে। এক সাপ্তাহ বাড়িতে আসার যাওয়া করে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। তারপর এক দিন হুজুর বললো সন্ধার সময় বাড়ি থেকে আসার সময় কাঁথা-বালিশ বিছানা পত্র নিয়ে এসো। রাতে মাদ্রাসায় থেকে পড়াশোনা করতে হবে।
সাপ্তাহের শুরুতে এক শনিবারে একটি বালিশ আর দুইটি কাঁথা এক সাথে রশি দিয়ে বেঁদে মাথায় নিয়ে গৃহ ত্যাগ করেছিলাম। সন্ধার সময় বাড়ি ছেড়ে আসার পথে মা আমার পিছু পিছু খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেছে। সেই তখন প্রথম ঘর ছেড়েছিলাম। তারপর থেকে ঘুমানোর স্থান অনির্দিষ্ট হয়ে গেলো। এক মাস মাদ্রাসার এক রুমে থাকলে পরের মাসে অন্য রুমে নিয়ে সিট দিতো। আমি নিজে একদিন অনুপস্থিত থাকলে ঘুমানোর জায়গাও অনুপস্থিত হয়ে যেতো।মসজিদ সহ সেই মাদ্রাসার কত রুমে রাত কাটিয়েছি তার কোন নির্ধারিত হিসাব নেই। সেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা অবস্থায় বিভিন্ন সেন্টারে এক্সাম দেওয়ার সুবাদে বাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন মসজিদে রাত্রি যাপন করেছি। ২০১২ সালে সেই মাদ্রাসা ত্যাগ করি। তারপর চলে যায় আমাদের পার্শ্ববর্তী আখাউড়া উপজেলার এক গ্রামের আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানেও হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতাম। বাড়িতে খুব কম যেতাম। সরকারি বন্ধ ছাড়া বাড়িতে তেমন যাওয়া হতো না। সেখানেই এসএসসি ও এইসএসসি কম্পিলিট করলাম। ইন্টার পরিক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার আগেই গৃহ ত্যাগ করার সংবাদ আসলো। ২০১৪ সালে ঢাকায় আগমন করলাম। ঢাকার ফার্মগেইট ও মগবাজারে চার মাস থেকে ভার্সিটি কোচিং করে ঢাবি সহ বিভিন্ন সরকারি বিশ্বাবিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দেয়। ঐ বছর ঢাবিতে দুইবার পরিক্ষা দেওয়ার শেষ সুযোগ ছিল। যার ফলে সিরিয়াল অনেক উপরে থাকায় ঢাবিতে পড়ার সুযোগ হয়নি। জগন্নাত বিশ্বাবিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তুু ঢাবিতে সুযোগ না পাওয়ার কারনে মন ভেঙ্গে যায়। যার ফলে পড়াশোনা ছেড়ে বিদেশ যাওয়া ভূত চাপে।
তখন ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়ে মাস খানেক থেকেছিলাম। তারপর অনিচ্ছা সত্তেও প্রিন্সিপাল স্যারের আদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে ভর্তি পরিক্ষা দেয়। ভর্তি পরিক্ষা দিয়ে রেজাল্ট পাওয়ার আগেই আবার গৃহ ত্যাগ করার সংবাদ আসে। আবার কাঁথা বালিশ নিয়ে গৃহ ত্যাগ করলাম। এক কাকার সাথে নারায়ণগঞ্জ চলে আসলাম। এখানে এক চাচার মাধ্যমে তার অফিসে চাকরির সুযোগ হয়। ২০১৫ সালের মে মাসের ১০ তারিখ চাকরীতে জয়েন করি। চাকরিতে জয়েন করার পরে বাড়িতে যাওয়া পালা আরো কমে গেলো। তখন বছরে এক দুইবার বাড়ি যেতাম। বাড়িতে গিয়ে এক রাত বা দুই রাত থেকেই চলে আসতে হতো। গত কয়েক বছর যাবৎ বছরে শুধু একবার কোরবানির ঈদে বাড়িতে যায়। এক বছর কোরবানির ঈদেও বাড়িতে যায়নি। গ্রামের প্রায় মানুষ আমাকে চিনেই না। আমাদের গ্রামে ১০ হাজারের উপরে মানুষ থাকলেও আমি ও আমাকে পাঁচশো মানুষও চিনে না। চিনবে কিভাবে ২০০২ সাল থেকে ঘর ছাড়া। সকালে বাড়িতে গেলে বিকালে নাই,বিকালে গেলে সকালে নেই।
প্রায় দুই যোগ ধরে ঘর ছাড়া। সেই এক সন্ধা বেলা কাঁথা বালিশ মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়েছিলাম। আজও আমি ঘর ছাড়া,ঘর থেকেও আজকে ঘর নেই। কত মানুষের বাড়িতে থেকেছি,কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে। কত উত্তান পতনের স্বাক্ষী হয়েছি। কত মানুষ বিয়োগ হয়েছে,কত মানুষ যোগ হয়েছে। ফেসবুকে আমাদের গ্রামের পেইজে কত মানুষের বিয়োগের সংবাদ পড়ি। হয়তো গ্রামে থাকলে তাদের জানাযায় উপস্থিত থাকতাম। জানিনা কখন ঘরে ফিরতে পারবো। নাকি ঘরে ফেরার আগেই মাটির ঘরের ডাক চলে আসে...।
সবাইকে ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।।
আমি একজন বাংলাদেশের সাধারন নাগরিক। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে আমার বসবাস। সিম্পল আমার স্বপ্ন সিম্পল আমার জীবন। স্টিমিট আমার জীবনের একটি অংশ, আমার বাংলা ব্লগ আমার পরিবার। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া বলতে আমি স্টিমিটকেই চিনি। ভ্রমন করা, ফটেগ্রাফি করা,ডিজাইন করা আর বই পড়া আমার স্বপ্ন। আমি বিশ্বাস করি মানুষের জীবনে উত্তান পতন আছেই। সর্বপরি কাজ করতে হবে লেগে থাকতে হবে, তাহলেই একদিন সফলতা আসবে,এটাই আমি বিশ্বাস করি। সবাইকে ধন্যবাদ।।
Bangla Witness কে সাপোর্ট করতে এখানে ক্লিক করুন
এখানে ক্লিক করো ডিসকর্ড চ্যানেলে জয়েন করার জন্য
Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power
250 SP 500 SP 1000 SP 2000 SP 5000 SP
Click Here For Join Heroism Discord Server
Thank you, friend!


I'm @steem.history, who is steem witness.
Thank you for witnessvoting for me.
please click it!
(Go to https://steemit.com/~witnesses and type fbslo at the bottom of the page)
The weight is reduced because of the lack of Voting Power. If you vote for me as a witness, you can get my little vote.
২০০২ সালে ঘর ছাড়ার পরও আপনি প্রতিটা ঘটনা এক এক করে উল্লেখ করেছেন সেটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো ছোটবেলায় রাকিবের সাথে স্কুলে যাওয়ার পর ওয়ান এ ভর্তি হওয়ার রোল নম্বরটা যে আপনার মনে আছে সেটা ভেবে অনেক ভালো লাগলো। আসলে মানুষের জীবনটাই এমন ব্যস্ততা মানুষকে স্বার্থপর করে রাখে নিজের গ্রাম নিজের মা নিজের মাতৃভূমি দূর করে রাখে। আসলে মানুষ যে প্রান্তেও থাকুক না কেন তার যে অবস্থায় থাকুক না কেন। নিজের মাতৃভূমিতে সে ফিরে আসতে চাই। আর না আসতে পারাটা মানুষের কাছে কষ্টের। ভালো লাগলো পোস্টটি পড়ে।
জী আপু ক্লাস ওয়ানের রোল নাম্বারটা আমার এখনও মনে আছে। আর জন্মাস্থানের স্মৃতি ভুলা যায় না। ধন্যবাদ।
আপনার পুরো পোস্টটি দেখে শুনে যা বুঝতে পারলাম আপনি নিজের বাড়িতে খুব কম সময়ই থেকেছেন। আসলে কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে যারা নিজ বাড়িতে কম বাইরে বেশি সময় পার করে। যাইহোক শেষে আপনার কথাটা শুনে খারাপ লাগলো যে আপনি নিজ বাড়িতে কি ফিরতে পারবেন নাকি নাকি তার আগেই মাটির ঘর আপনাকে ডেকে নেবে। যাইহোক আপনার জন্য দোয়া করি ভাই আল্লাহ তাআলা আপনাকে যেখানে রাখুক ভালো রাখুক।
আমাদের জীবন অনিশ্চিত,কত মানুষ আছে নিজের তৈরী করা ঘরে প্রবেশ করার আগে মাটির ঘরে প্রবেশ করে। সেই চিন্তা থেকেই বাক্যটা লিখলাম। ধন্যবাদ।
লেখাপড়ার কারনে কিংবা চাকরি সূত্রে আমরা অনেকেই বাড়ির বাইরে থাকি।কিন্তু আপনি অনেক ছোট থেকেই ঘর ছাড়া।এতো এতো গল্প আজ আপনার পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম।হয়তো নিজের বাড়িতে থাকা হচ্ছে না।চাকরির সূত্রে পরিবার নিয়ে শহরে আছেন।পরিবার নিয়ে থাকতে পারাটা ও ভাগ্যের ব্যাপার।ধন্যবাদ ভাইয়া অনুভূতি গুলো শেয়ার করার জন্য।
জী আপু বাড়ির বাইরে থাকলেও ভালো আছি ,আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ।