জেনারেল রাইটিং || শৈশবের স্মৃতিচারণ: বিষপান

in আমার বাংলা ব্লগlast year

নমস্কার,

তোমরা সবাই কেমন আছো? আশা করি, সবাই অনেক অনেক ভাল আছো। আমিও বেশ ভালো আছি।

poison-1481596_1280.jpg

ইমেজ সোর্স

আমাদের গ্রামটি খুব একটা বড় ছিল না। মোটামুটি ২০০ থেকে ২২০ জন লোকের বসবাস ছিল তখন আমাদের গ্রামে। আমাদের ওই গ্রামে বিকর্ণদের বাড়ি ছিল একদম গ্রামের বাজারের কাছের একটি জায়গায়। বিকর্ণদের পরিবার ছিল বেশ সম্ভ্রান্ত কারণ তার ঠাকুর দাদার অনেক জায়গা জমি ছিল। পাঁচ ভাই-বোনদের ভিতর বিকর্ণ ছিল সব থেকে ছোট। এই বিকর্ণর বয়স যখন ষোলো বছর আমার বয়স তখন আট। তবে আমার বয়স অল্প হলেও বিকর্ণর সাথে আমার অনেক ভাব ছিল। মাঝে মাঝে আমি তার সাথে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামের মধ্যে।

সে খুব ফ্রেন্ডলি ছিল এবং সবার সাথেই খুব ভালোভাবে মিশতো। তবে গ্রামের অনেক ছেলেরা বিকর্ণকে অনেক খারাপ কথা বলতো তার কথা বলার স্টাইলের কারণে। সত্যি কথা বলতে বিকর্ণর কথা বলার স্টাইল ছিল একটু মেয়েদের মত এবং তার স্বভাবের ভিতর কিছু মেয়েলি স্বভাবও ছিল। তাই জন্য অনেকে তাকে "বিটি" বলে ডাকতো। গ্রামের ভাষায় "বিটি" মানে মহিলা। বিকর্ণ মনের দিক দিয়ে খুবই ভালো ছিল। মাঝে মাঝে সে আমাকে বাজার থেকে খাবারও কিনে দিত। বিকর্ণর সাথে আমরা ছোটরা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলোও করতাম। তার ভিতরে ক্রিকেট, ফুটবল এবং গ্রামীন অনেক খেলাধুলোও ছিল।

বিকর্ণদের বাড়ির সামনের আম গাছে দোলনা টানানো থাকতো। আমরা অনেকে সেখানে গিয়ে দোলও খেতাম। আর বিকর্ণ আমাদের এই দোল খেতে সাহায্য করতো। এই রকম ভাবে একটা সম্পর্ক ছিল বিকর্ণর সাথে আমাদের। বিকর্ণ সবসময় হাসিখুশি থাকলেও মাঝে মাঝে দেখতাম প্রচন্ড মন খারাপ করে রয়েছে। তবে তার কাছে মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে সে বলত না। তবে যতটুক তখন বুঝতে পারতাম সেটা হল, তার পরিবার থেকে তাকে বিভিন্ন ধরনের কথা বলা হতো তার এই মেয়েলি স্বভাবের কারণে আর হয়তো সেই জন্যেই সে মন খারাপ করে থাকতো।

বিকর্ণ কিন্তু দেখতে শুনতে খুব ভাল ছিল। অনেক লম্বা ও ফর্সা ছিল সে। যাইহোক, হঠাৎ করে একদিন দুপুরের সময় শুনতে পাই, বিকর্ণ বিষ খেয়ে নিয়েছে এবং বাড়িতেই ছটফট করছে। এই বিষ ছিল জমিতে দেওয়ার জন্য রাখা বিষ । আর যেহেতু গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছিল তাই সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটনাটি রটে গেছিল সারা গ্রামে। সেই সময়ই সবাই দৌড়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছিল বিকর্ণদের বাড়িতে। আমিও এই ঘটনা শুনে দৌড়ে ছুটে যাই বিকর্ণদের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখি শত লোক জমা হয়ে গেছে তাদের বাড়ির উঠোনে। বিকর্ণর বিষপান পরবর্তী ছটফট দেখে আমি তো কান্না করে দিয়েছিলাম।

চোখের সামনে এরকম কোন ঘটনা আমি প্রথমবার সেই দিনই দেখেছিলাম। বিকর্ণ বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করছিল যা তার এক্সপ্রেশন গুলো দেখে মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার নিঃশ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছিল সেটা তাকে দেখেই আমরা বুঝতে পারছিলাম। সেদিন সে অনেকটা বিষপান করে ফেলেছিল। আর যেহেতু গ্রামের হসপিটাল ছিল অনেকটা দূরে তাই তাকে হসপিটালে না নিয়ে গিয়ে, বাড়িতেই স্থানীয় এক ডাক্তারকে ডেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার কোন কিছুই করতে পারছিল না। বিষপান করলে গ্রামের দিকে গোবরের জল খাইয়ে বমি করানো হয়। যার ফলে কিছুটা বিষ কমে যায়। এই কাজও বিকর্ণকে করা হয়। সে কয়েকবার বমিও করে। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হয় না।

আস্তে আস্তে সে নিস্তেজ হতে থাকে, অনেকটা শান্ত হয়ে যায় সে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সেই সময় তার শরীরের বর্ণও অন্যরকম হয়ে যায়। চোখের সামনেই সবকিছু ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু কেউই কোন কিছু করতে পারছিল না পরিস্থিতি এরকম ছিল। আস্তে আস্তে তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং তাকে বাঁচানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। চোখের সামনে বিকর্ণর এরকম মৃত্যু দেখে আমি নিজেই ঘোরের মধ্যে চলে যাই। তার এমন ভাবে মৃত্যু আমি তখন মেনে নিতে পারিনি। সত্যি বলতে, এখনো পর্যন্ত আমি তার এই মৃত্যু মেনে নিতে পারিনি। আর চোখের সামনে এরকম দেখা ঘটনা সত্যিই আমার মনে অনেক আঘাত এনেছিল।

গ্রামে বিষপানে মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু অনেক দেখা যায়। মানুষ অনেক কষ্টে পেয়ে হয়তো এরকম পথ বেছে নেয়।তবে আমি এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না। একটা জীবনের কত মূল্য আছে, সেটা যদি কেউ না বুঝে এই মৃত্যুর পথ বেছে নেয় তাহলে সেখানে কোন কিছু বলার থাকে না। প্রতিবছর এই বিষপানে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি মানুষ হাজার চেষ্টা করেও বেঁচে থাকতে পারে না অথচ সুস্থ জীবন পেয়েও অনেকে মরে যাওয়ার মত এরকম সিদ্ধান্ত নেয় যা মোটেও ঠিক কাজ না। সবাইকেই মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে হয়তো মানুষ এরকম বড় ধরনের ডিসিশন কখনোই নেবে না।


পোস্ট বিবরণ

শ্রেণীজেনারেল রাইটিং
লোকেশনবারাসাত , ওয়েস্ট বেঙ্গল।
বন্ধুরা, আজকের এই ব্লগটি তোমাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট এর মাধ্যমে জানিও । সবাই ভালো থাকো, সুস্থ থাকো , সুন্দর থাকো ,হাসিখুশি থাকো , নিজের পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকো , সবার জন্য এই শুভকামনা রইল।

ধন্যবাদ সবাইকে






আমার পরিচয়

IMG_20220728_164437.jpg

আমি সুবীর বিশ্বাস( রঙিন)। কলকাতার বারাসাতে আমি বসবাস করি। আমি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিস এন্ড ফিসারিস সাবজেক্ট নিয়ে। বর্তমানে আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যানরত আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটু শান্ত স্বভাবের । চুপচাপ থাকতেই বেশি ভালোবাসি আমি। নতুন নতুন জিনিস শিখতে আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আর্ট করা, ফটোগ্রাফি করা, রেসিপি করা , গল্প লেখা আমার বেশ ভালো লাগে। আমি স্টিমিটকে অনেক ভালোবাসি এবং সব সময় স্টিমিটে কাজ করতে চাই।

🌷🌷 সমাপ্ত 🌷🌷

Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

You've got a free upvote from witness fuli.
Peace & Love!

 last year 

এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায় অনেকেই সুস্থ জীবন যাপনের জন্য যুদ্ধ করে চলেছে আর অনেকেই সুস্থ জীবনকে বিষপানের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

 last year 

ভাই, আপনার মত আমাদের মাথায়ও এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খায় সবসময়।

 last year 

আজকে যে গল্পটি শেয়ার করলেন সত্যিই অনেক দুঃখজনক। আমাদের সমাজে এরকম স্বভাবের অনেক মানুষ আছে যাদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা তামাশা করে থাকে মানুষ। যেটা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ এটা তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে করা নয় । সেই কারণেই বিকন্ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। আপনার সাথে ভালো বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ ছিল। সত্যি এই ধরনের মানুষগুলো যখন বিদায় নেয় সেই মুহূর্তটা জীবনের সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত হয়ে থাকে।

 last year 

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই, আপনার এই কথাগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।

 last year 

আপনার আজকের এই পোস্ট পড়ে সত্যি আমার অনেক বেশি খারাপ লেগেছে। কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যারা জীবনে এত বেশি অতিষ্ঠ হয়ে যায় যে, তাদের শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাটাকে বেছে নেওয়া লাগে। বিকর্ণর সাথেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। তার ফ্যামিলির লোকজন তার এরকম স্বভাবের জন্য বিভিন্ন কথা বলতো। এই জন্যই হয়তো অনেক দুঃখ কষ্টে এই সিদ্ধান্তটা নিতে সে বাধ্য হয়েছে। তর তাজা একটা প্রাণ যদি নিমিষেই চোখের সামনে চলে যায়, তখন এটা মেনে নেওয়া আসলেই সম্ভব হয় না। মানুষ আত্মহত্যার ব্যাপারটা একদিনে ডিসিশন নিয়ে করে না। অনেক ভেবেচিন্তে তারপর তারা এই ডিসিশনটা নিয়ে থাকে। তবে এটা কোন কিছুর সমাধান হয় না। যাই হোক সুন্দর করে পুরোটা লিখেছেন পড়ে অনেক খারাপ লাগলো।

 last year 

মানুষ আত্মহত্যার ব্যাপারটা একদিনে ডিসিশন নিয়ে করে না। অনেক ভেবেচিন্তে তারপর তারা এই ডিসিশনটা নিয়ে থাকে।

হ্যাঁ ভাই, ঠিক কথা বলেছেন। যাইহোক, আপনার এই মন্তব্যটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

 last year 

যদিও এরকম দৃশ্য সরাসরি এখনো দেখিনি। তবে এটাই কামনা করি যেন এরকম দৃশ্য কখনো না দেখতে হয়। যেহেতু আপনার চোখের সামনেই এই ঘটনাটা ঘটেছে, এজন্য আপনার মাথায় একেবারে গেঁথে গিয়েছে। বিকর্নর কথা ভাবতেই অনেক বেশি খারাপ লাগতেছে। একটা মানুষ কিভাবে পারে নিজের জীবনটা নিজের হাতেই শেষ করে দিতে এটাই ভেবে পাইনা আমি। কষ্ট রাগ এগুলো থাকলে দূরে কোথাও চলে যাক না, তবুও কেন নিজের জীবন শেষ করে। অনেকে বাঁচতে চায় অনেকে নিজের ইচ্ছায় মারা যায়। এটা তখনই মানুষের পক্ষে সম্ভব, যখন তার আর কোন কিছুই থাকে না। নিজের ভেতরে অনেক বেশি কষ্ট থাকে। তিলে তিলে নিজের ভেতরেই শেষ হয়ে যায়।

 last year 

এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথাগুলো বলার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু আপনাকে । ভালো লাগলো, আপনার লেখা এই কথাগুলো পড়ে।

 last year 

আমাদের সমাজের মানুষরা এমনই কোনো কিছু নিয়ে সমালোচনা করা বাদ দিবে না।যদিও এরা আসলে মানুষের পর্যায়েই পরে না।কি দোষ তার। তারও সমাজে অন্যান্যদের মতো স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার অধিকার ছিলো।খুব খারাপ লাগলো ঘটনাটি পড়ে।সত্যি ভাইয়া এমন দুঃখজনক ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখলে খারাপ লাগারই কথা।

 last year 

হ্যাঁ আপু, অনেক খারাপ লেগেছিল আমার তখন। এখনও যখন এই ঘটনাটা মনে করি, বেশ কষ্ট লাগে আমার।