মানুষ আগে নাকি মনুষ্যত্ব আগে?
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, আসলেই কি মানুষ হওয়াটাই যথেষ্ট, নাকি তার চেয়েও বড় কিছু আছে যাকে আমরা বলি মনুষ্যত্ব? জন্মসূত্রে মানুষ হওয়া সহজ, কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন এক কঠিন সাধনা। এই প্রশ্নটি বহু পুরনো মানুষ আগে না মনুষ্যত্ব? এক গভীর ভাবনার দরজা খুলে দেয় এ প্রশ্ন, যার উত্তর একেক জনের কাছে একেক রকম হলেও, মূলত উত্তর খোঁজার এই যাত্রাটাই অনেক বড় ব্যাপার।চলুন আজকে মানুষ ও মনুষত্ব নিয়ে আপনাদের সাথে কিছু কথা শেয়ার করি।
আমরা জন্মাই মানুষ হিসেবে। নাম, জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা সবকিছু নিয়েই একটি পরিচয় গড়ে ওঠে। সমাজ আমাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, আমাদের অধিকার দেয়, কর্তব্য শেখায়। কিন্তু মনুষ্যত্ব? সেটা সমাজ শেখায় না, সেটা গড়ে ওঠে আমাদের ভিতর থেকে, ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়ে। এক ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য দিয়ে সাহায্য করা, রাস্তার পাশে আহত প্রাণীকে তোলা, মায়ের কষ্ট দেখে পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যাওয়া এসবই মনুষ্যত্বের নিদর্শন।মানুষের রূপ ধারণ করলেই যদি সব কিছু হতো, তবে ইতিহাসে এত নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধ, হত্যা, লোভ, বিভেদ থাকত না। অনেক সময় দেখা যায়, একজন মানুষ তার চেহারায়, শিক্ষায়, প্রতিপত্তিতে মানুষ হলেও তার ভেতরে মনুষ্যত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। আবার, এক অশিক্ষিত কিংবা গরিব মানুষকেও দেখা যায় এমন মনোভাব ও কর্মের পরিচয় দিতে, যা সত্যিকার অর্থে মনুষ্যত্বকে প্রতিফলিত করে।
মনুষ্যত্ব এমন একটি গুণ, যা জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় কিংবা বয়স-লিঙ্গ কোনো কিছুর সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে না। এটা একটি সার্বজনীন মানবিকতা। মনুষ্যত্ব এমন এক আলো, যা শুধু নিজের জীবন নয়, অন্যের জীবনকেও আলোকিত করতে পারে। যে ব্যক্তি নিজে না খেয়ে অপরকে খাওয়াতে পারে, সে-ই মনুষ্যত্বের আসল উদাহরণ।আমরা আজ প্রযুক্তির কারনে অনেক দূর এগিয়ে গেছি, কিন্তু সেই সঙ্গে কি মনুষ্যত্বেও এগিয়েছি? রাস্তার পাশে একজন বৃদ্ধকে পড়ে থাকতে দেখে যদি আমরা ক্যামেরা অন করি কিন্তু সাহায্যের হাত না বাড়াই, তাহলে আমরা মানুষ হলেও মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় ফেল। মনুষ্যত্ব মানে কেবল দান করা বা সাহায্য করাই নয়, বরং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে ভাবা, অনুভব করা এইসব কিছুই মনুষ্যত্বের অংশ।
একটি শিশু যখন কান্না করে, একজন সত্যিকারের মানুষ তাকে কোলে তুলে শান্ত করতে জানে। যখন কেউ নিপীড়নের শিকার হয়, তখন একজন সত্যিকারের মানুষ প্রতিবাদ করে। মনুষ্যত্ব কেবল কথায় নয়, কাজে প্রকাশ পায়। একজন মানুষের পরনে দামি পোশাক, উচ্চতর ডিগ্রি, বড় পদ এসব তাকে সমাজে উচ্চ মর্যাদা দিতে পারে, কিন্তু মনুষ্যত্ব না থাকলে সে এক ফাঁপা আবরণ মাত্র।মনুষ্যত্বের অভাবেই আজ সমাজে এত হানাহানি, প্রতারণা, আত্মকেন্দ্রিকতা দেখা যায়। কেউ কারো খবর রাখে না, ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে দূরে সরে যায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। অথচ একটু মন দিয়ে খেয়াল করলেই দেখা যায়, একজন মানুষের মনুষ্যত্বই পারে অপরের জীবনে আশার আলো জ্বালাতে।
একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়। এক শীতের রাতে এক রিকশাওয়ালা যখন কাপড় না পেয়ে কাঁপছিল, তখন এক অচেনা পথচারী তার নিজের গায়ের চাদর খুলে দিয়ে বলেছিল"এই নাও মামা, এটা দিয়ে রাতে ঘুমাও। আমি বাসায় গিয়ে আরেকটা বের করব।" এই ছোট্ট কাজটি হয়তো সমাজে কোনো বড় খবর নয়, কিন্তু এর মাঝে যে মনুষ্যত্ব লুকিয়ে আছে, তা অনেক বড় কিছু।
এভাবে ভাবলে দেখা যায়, মনুষ্যত্ব ছাড়া মানুষ হওয়া এক অর্থহীন অস্তিত্ব। আমরা সবাই মানুষ হিসেবে জন্মাই, কিন্তু আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত মনুষ্যত্ব অর্জনের। কারণ পৃথিবী আজ মানুষের চেয়ে মনুষ্যত্বের অভাবে বেশি কষ্ট পাচ্ছে।মানুষ হওয়া জন্মগত, কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন চিরকালীন সাধনা। এই সাধনায় যারা এগিয়ে যায়, তারাই প্রকৃত মানুষ। তাই হয়তো কেউ কেউ বলেন, "মানুষ নয়, মনুষ্যত্বই আগে। মানুষ তো সবাই, কিন্তু মনুষ্যত্ব সবার নেই।"
আজ এখানেই শেষ করছি। অন্য কোন একদিন ভিন্ন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আপনাদের মাঝে হাজির হব। ততক্ষন পর্যন্ত আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
X-Promotion
আসলে ভাই আমার কাছে দুইটাই আগে। নিজেকে মানুষের উপর পরিচয় দিতে হলে অবশ্যই মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে হবে। মানুষরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই মানুষত্ব জাগ্রত রাখতে হবে। যে ব্যক্তি শীতে অসহায় মানুষের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তার মধ্যে মানুষত্ব রয়েছে। যার মধ্যে মানুষত্ব রয়েছে সে শুধু নিজের সুবিধা বোঝেনা সকলের সুবিধা বোঝার চেষ্টা করে।