আধুনিক শিক্ষার্থী ও মূল্যবোধের অবক্ষয়: এক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা

in আমার বাংলা ব্লগ5 days ago

আধুনিক শিক্ষার্থী ও মূল্যবোধের অবক্ষয়: এক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


game-1553995_1280.jpg
সোর্স

বর্তমান সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে এক গভীর পরিবর্তনের সাক্ষী আমরা সবাই, বিশেষত যাঁরা সরাসরি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট দেখা যায়—আধুনিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগের দিনের মতো মূল্যবোধ, শিষ্টাচার ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেকাংশেই কমে গেছে। বিষয়টি কেবল শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এর গভীরে রয়েছে পারিবারিক অবহেলা, প্রযুক্তির অতি ব্যবহার, সামাজিক অস্থিরতা এবং মূল্যবোধ শেখানোর অভাব।

এক সময় বিদ্যালয় ছিল একটি পবিত্র স্থান, যেখানে শিক্ষার্থী শুধু পড়াশোনা করত না, জীবন গঠনের আদর্শও শিখত। শিক্ষক ছিলেন মনের গুরু, যাঁর নির্দেশ ও পরামর্শ শিক্ষার্থীর জীবনে ছিল পথপ্রদর্শকের মতো। কিন্তু এখন বহু শিক্ষার্থী শিক্ষককে একজন কেবল পাঠদাতা বা পরীক্ষা পাশ করানোর যন্ত্র হিসেবে দেখে। শিক্ষকের পরামর্শ উপেক্ষা করা, শ্রেণিকক্ষে অমনোযোগী আচরণ, এমনকি অনেক সময় কটুক্তি বা দুর্ব্যবহার—এসব এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো পারিবারিক শিক্ষা ও সময়ের অভাব। আধুনিক যুগে অধিকাংশ বাবা-মা কর্মজীবী, ফলে সন্তানদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ গড়ে তোলার সুযোগ তাঁদের খুব কমই থাকে। অনেক অভিভাবক সন্তানকে সময় না দিয়ে মোবাইল, ট্যাব বা টিভির হাতে তুলে দেন, যা কিছুক্ষণের জন্য হয়তো তাদের ব্যস্ত রাখে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শিশুর মানসিক বিকাশে বিপরীত প্রভাব ফেলে। শিশুর মনে শৃঙ্খলা, সহানুভূতি ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য যা দরকার—সেসব অভ্যাস গঠনের সুযোগ তারা পায় না।

অন্যদিকে, প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী প্রভাবও শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এনেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার, ইউটিউব বা রিল ভিডিওর মাধ্যমে অল্প বয়সেই তারা এমন কনটেন্টের মুখোমুখি হচ্ছে, যা তাদের মননে অপরিণত চিন্তাধারা গড়ে তোলে। ধৈর্য্য, শ্রদ্ধাবোধ বা সংযমের মতো গুণাবলির স্থান নিচ্ছে হুজুগ, গ্ল্যামার আর কৃত্রিমতা। ফলত, বিদ্যালয় বা শিক্ষকের প্রতি আগ্রহের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর।

এই পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ের ভূমিকা হয়ে উঠেছে আরও চ্যালেঞ্জিং। শিক্ষককে শুধু পাঠদান নয়, এক একজন মনোবিশেষজ্ঞের মতো আচরণ করতে হচ্ছে—শিক্ষার্থীর মন বোঝা, তাদের মানসিক সমস্যা শনাক্ত করা এবং ধৈর্য্য সহকারে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা এখন শিক্ষকতার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিক্ষক সমাজ আজও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও মানসিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত। একদিকে কাজের চাপ, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের এমন মনোভাব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।

তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এখনো অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা শালীন, নম্র, দায়িত্ববান ও মনোযোগী। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, বাকিদেরও সেই পথে আনা। এই পরিবর্তন সম্ভব একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে—পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজ একসঙ্গে কাজ করলে, শিশুদের ছোটবেলা থেকেই মানবিকতা, সহানুভূতি ও শিষ্টাচারের পাঠ দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবারও হয়ে উঠবে আলোকিত।

সবশেষে বলতেই হয়, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নাগরিক। তাদের মধ্যে যদি আমরা সঠিক মূল্যবোধ, চরিত্র ও দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সমাজের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই আরও আলোকোজ্জ্বল হবে। এবং এই কাজটি শুরু হোক আজই—পরিবারের কোণায় কোণায় এবং শ্রেণিকক্ষের প্রতিটি বেঞ্চে।


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

6VvuHGsoU2QBt9MXeXNdDuyd4Bmd63j7zJymDTWgdcJjo1LsUc8S2zjHiaW6UcX2M5SAfbrPcxiCjQzCc6aZJSjUDgt85bSStrwGCUjZMWCDKxNata4NQ2cZTKGxsY.png

FrDSZio5ZCzUamf35asauSgs1tnNGCc8exBrDii52qi3JpjTyYCF9oFoYfs1EV4VTnFw6faxzt5X7uHiwMAHmLS3ef2Jb2JcxHBkpRBd2y...Qa3Q3c7Biv4c8mKsr8DHNVYqqpVomFSv1wmkMCbhs7oCjb14sjkA3vxAfSRk8QPzNZ5UirrZUzvHCXygHCV49RVVZBeTFCeo47WcQXnjLYGy2RNdJQycJW4cN.jpeg

2N61tyyncFaFVtpM8rCsJzDgecVMtkz4jpzBsszXjhqan9xBEnshRDSVua5J9tfneqYmTykad6e45JWJ8nD2xQm2GCLhDHXW9g25SxugWCoAi3D22U3571jpHMFrwvchLVQhxhATMitu.gif