কলকাতার বিখ্যাত ফিরিঙ্গি কালিবাড়ী। কিছু ইতিহাস কিছু কথা।

in আমার বাংলা ব্লগ2 months ago

কলকাতার বিখ্যাত ফিরিঙ্গী কালী

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


friendship-2366958_1280.jpg
সোর্স


🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏


কলকাতা তখন মহানগরী নয়। ভাগীরথীর তীরে এক নির্জন পাড়াগাঁ। এখন যেখানে গমগমে সেন্ট্রাল এভিনিউ, সারাদিনের তুমুল ব্যস্ততা, তখন সেখানেই গঙ্গার তীর ঘেঁষা গভীর জঙ্গল। সামান্য কিছু জনবসতি আর সাপখোপ ও হিংস্র পশুর বিচরণভূমি। বেশ অবাক করা বিষয়। তাই না? যাই হোক। আমরা আজ সেই ৫০০ বছর আগের কলকাতায় যাব।
বৌবাজার হয়ে লালবাজারের দিকে আসার সময় কখনো ডানদিকে একটা সাদামাটা অথচ ব্যতিক্রমী মন্দির চোখে পড়েছে কি? নিশ্চয় পড়েছে। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী। চোখ পড়লে খেয়াল করবেন, সামনে দেয়ালে স্পষ্ট লেখা রয়েছে -

ওঁ শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরাণী
২৪৪ বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট
কলিকাতা - ৭০০০১২
স্থাপিত - ৯০৫ সাল
ফিরিঙ্গী কালী মন্দির।"

এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। হ্যাঁ, আমরা কথা বলছি কলকাতার বিখ্যাত ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি নিয়ে। ৯০৫ বঙ্গাব্দ বা ইংরাজি ১৪৯৮ খ্রীস্টাব্দ। অর্থাৎ সময় চাকার হিসাবে ৫২১ বছর আগে। কলকাতা শহর তো দূরের কথা, নবদ্বীপে তখন শিশু অবস্থায় খেলা করে বেড়াচ্ছেন বাঙালীর প্রথম অবিসংবাদী কিংবদন্তী মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব। আর ঠিক তখনই গঙ্গার তীরে কলকাতায় জঙ্গলের গভীরে প্রতিষ্ঠা হয় এক শিবমন্দির। সঙ্গে মা শীতলা। হোগলা পাতা দিতে ঘেরা মন্দিরে পূজিত হতেন দেবতা। কিছুদিন পরেই দৈবক্রমে মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হয় মঞ্চমুন্ডির আসন। সেখান থেকেই কালীমন্দির। সে নাহয় হল। ৫০০ বছর আগের জঙ্গলে ঘেরা কলকাতায় তৈরি হল জাগ্রত কালীদেবীর মন্দির। কিন্তু তার সাথে ফিরিঙ্গী যোগ কোথায়? বিলক্ষণ আছে। তবে তা নিয়ে আছে মতান্তরও। আসছি সেই কাহিনীতেও। তবে তার আগে যার কথা না বললে এই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় না, তিনি শ্রীমন্ত ডোম। ডোম অর্থে অন্ত্যজ শ্রেণী নাকি ফিরিঙ্গী সে নিয়ে মতবিরোধ আছে, থাকবেও। তবে শ্রীমন্ত ডোমের হাতে মাতৃমূর্তি যে প্রায় ৭০ বছর সেবিত ছিলেন তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই শ্রীমন্ত ডোমই হয়ে উঠেছিলেন শ্রীমন্ত পন্ডিত। অনেকে অবশ্য তাঁকে পূজারী ব্রাহ্মণ হিসাবেও পরিচয় দিয়েছেন। বাংলায় তখন ইংরেজ কোম্পানির শাসন। মন্দিরে সেবিতা শীতলা দেবীর কৃপায় স্থানীয় ফিরিঙ্গী জনজাতির মধ্যে বসন্ত রোগের চিকিৎসাও করতেন শ্রীমন্ত। তাই সেযুগে তাঁর মস্ত হাঁকডাক। মন্দিরে কালীমূর্তির পাশে শীতলাদেবীর মূর্তি আজও দেখা যায়। বসন্ত রোগ থেকে সেরে উঠে ফিরিঙ্গীরা নিয়ম করে পুজো পাঠিয়ে সেবা করতো মন্দিরের। সেই থেকেই ফিরিঙ্গী কালী।
কিন্তু এই গল্প শুনতে শুনতেই পাশ থেকে রে রে করে উঠবেন হয়ত কেউ কেউ। ফিরিঙ্গী কালীবাড়ির কথা হবে আর সেখানে আসবেন না বাংলার একসময়ের দাপুটে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী সাহেবের কথা? শোভাবাজার থেকে শ্রীরামপুর, যশোর থেকে যানবাজার গানে গানে কাঁপিয়ে তোলা লোকটা যে কালীর একনিষ্ঠ একজন সাধক তা আর ইতিহাসপ্রেমীরা কে না জানে। একজন অবাঙালী ফিরিঙ্গী হয়েও তখন তিনি নিয়ম করে বাজি ধরছেন ভোলা ময়রা, ঠাকুর দাস সিংহ বা রাম বসুর মতো বিখ্যাত বাঙালী কবিয়ালদের সঙ্গে। দিনরাত পড়ে থাকছেন হিন্দুশাস্ত্র, উপনিষদ, গূঢ় কালীতত্ত্ব নিয়ে। ডুবে থাকছেন বাংলার সংস্কৃতিতেই। এমনকি বিয়েও করেছেন হিন্দু ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবাকে। আজকের যুগ হলে হয়ত মস্ত তারকার আখ্যা পেতেন তিনি। একান্ত নিজগুণেই মাটিতে পা পড়বার কথাও ছিল না তাঁর। কিন্তু তখন ফরাসডাঙায় (এখন চন্দননগর) ধনী পর্তুগীজ ব্যবসায়ীর ছেলে হ্যান্সবেন অ্যান্টনি সাধারণ বাঙালী বিধবা সৌদামিনীকে বিয়ে করে ফরাসডাঙার কাছেই গরীটিতে বাগানের মধ্যে ছোট্ট বাড়ি তৈরি করে একা বাস করতেন। সেটিই তাঁর কবিগানের সাধনস্থল। হিন্দু স্ত্রীয়ের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে আয়োজন করতেন দুর্গাপূজোর। আর আরাধ্য দেবী কালীর টানে আসতেন বৌবাজারের ফিরিঙ্গী কালীমন্দিরে। এ যেন তাঁর নিজের জায়গা। কাছেই অ্যান্টনি বাগানে তাঁর দাদুর বাগানবাড়ি (শোনা যায় তাঁর দাদুর নামও ছিল অ্যান্টনি)।

কম বয়সে স্থানীয় কবির দলের সাথে দিকে দিকে ঘুরলেও পরে কিছু টাকাপয়সা জমিয়ে নিজেই কবিগানের দল গড়লেন। প্রথম প্রথম গান বেঁধে দিতেন গোরক্ষনাথ। পরে গানের বাঁধুনিতেও চমৎকার দক্ষ হয়ে ওঠেন অ্যান্টনি। তাঁর গান আজও বাংলা লোকসংস্কৃতি গবেষকদের কাছে সম্পদ।
দীনেশ চন্দ্র সেন লিখছেন, সেই সময়ে মন্দিরের ও বিগ্রহের দেখাশোনা করতেন প্রমিলা সুন্দরী দেবী। তিনি ব্রাহ্মণঘরের কমবয়সী বিধবা। অ্যান্টনি সাহেবের নিয়মিত যাতায়াতের কারণে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক মধুর সখ্যতা। প্রমিলাদেবী ছিলেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বউ। এই পরিবারটিই ফিরিঙ্গী কালীর বংশানুক্রমিক সেবায়েত বলে জানা যায়। ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে নিঃসন্তান শ্রীমন্ত পন্ডিত নিজেই কালীবাড়ির দেবোত্তর সমেত মাত্র ৬০ টাকার বিনিময়ে পোলবার শ্রী শশিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমগ্র মন্দিরটি বিক্রি করে দেন। সেই থেকেই ওই পরিবারের হাতে সেবিত দেবী কালী। পরে অ্যান্টনি কবিয়ালের হাত ধরে বিভিন্ন সময় মন্দিরে চলে সংস্কার পর্ব। নামকরা কবিয়ালদের হারিয়ে সেই অর্থ বিভিন্ন ভাবে তিনি খরচ করেন দেবীমূর্তি ও মন্দিরের সংস্কারে। কিন্তু ৫০০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ফিরিঙ্গী কালীমন্দির যে একক ভাবে অ্যান্টনি কবিয়ালের হাতে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়, তা সহজেই স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ সময়কালের হিসেব সেই তথ্যে শিলমোহর দেয় না।

আজও মন্দিরে দেবী কালীর সাথে পূজিত হয়ে আসছেন আরও বিভিন্ন দেবদেবী। মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি, জগদ্ধাত্রী এবং নারায়ণ শিলা। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সেবিত হলেও মন্দিরের প্রতিটি ইটে এখনও লেগে আছে ফিরিঙ্গীদের স্মৃতি আর পুরনো কলকাতার গন্ধ। প্রাচীন রীতি মেনে প্রতিবছর দীপান্বিতা অমাবস্যায় সাড়ম্বরে পালিত হয় পুজো ও অন্নকূট উৎসব। সাজানো হয় মন্দির। বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে ভিড় করেন ভক্তরা। এমনকি বিদেশের পর্যটক ও গোয়ার পর্তুগীজদের কাছেও এই মন্দির এক অন্যতম আকর্ষণ। আগে মাতৃমূর্তির সামনে পশুবলি হলেও ২০১৩ সাল থেকে তা সম্পূর্ণ বন্ধ।

এভাবেই প্রাচীন বিভিন্ন রকমের লোকমত আর কিংবদন্তি নিয়ে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বৌবাজার ফিরিঙ্গী কালীমন্দির। প্রাচীনত্বের ইটপাথরে মতান্তর থাকবেই, পরবর্তীতেও জন্মাবে নতুন নতুন তর্ক। কিন্তু তার মধ্যে চাপা পড়ে থাকা ইতিহাসটাও বেরিয়ে আসবে কৌতুহলের অমোঘ টানেই। আমরাও খুঁজে বেড়াই মাটির নীচে হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি স্তুর। আলো আর অন্ধকারে চলে যায় বছরের পর বছর। গঙ্গা দিয়ে অনবরত বয়ে যায় স্রোত। কিন্তু পুরনো হন না শ্রীমন্ত পন্ডিত, অ্যান্টনি কবিয়াল কিংবা শশিভূষণ বন্দ্যোপাধ্য়রা। বিস্মৃতির অন্ধকার থেকেই তাঁরা অমরত্ব পান শহর কলকাতায়।


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

6VvuHGsoU2QBt9MXeXNdDuyd4Bmd63j7zJymDTWgdcJjo1LsUc8S2zjHiaW6UcX2M5SAfbrPcxiCjQzCc6aZJSjUDgt85bSStrwGCUjZMWCDKxNata4NQ2cZTKGxsY.png

FrDSZio5ZCzUamf35asauSgs1tnNGCc8exBrDii52qi3JpjTyYCF9oFoYfs1EV4VTnFw6faxzt5X7uHiwMAHmLS3ef2Jb2JcxHBkpRBd2y...Qa3Q3c7Biv4c8mKsr8DHNVYqqpVomFSv1wmkMCbhs7oCjb14sjkA3vxAfSRk8QPzNZ5UirrZUzvHCXygHCV49RVVZBeTFCeo47WcQXnjLYGy2RNdJQycJW4cN.jpeg

2N61tyyncFaFVtpM8rCsJzDgecVMtkz4jpzBsszXjhqan9xBEnshRDSVua5J9tfneqYmTykad6e45JWJ8nD2xQm2GCLhDHXW9g25SxugWCoAi3D22U3571jpHMFrwvchLVQhxhATMitu.gif