নববর্ষের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান – এক বর্ণময় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা
নববর্ষের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান – এক বর্ণময় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা
🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏
বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ, আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি ঘিরে থাকে উৎসব, আনন্দ আর মিলনের আবহ। এ বছর এই দিনটি আরও বিশেষ হয়ে উঠেছিল, কারণ আমি এবং আমার কন্যা অংশ নিয়েছিলাম কোন্নগর রামেন্দ্র পাঠভবন লাইব্রেরীতে আয়োজিত এক অনন্য বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে।
সকাল সকাল, সূর্যোদয়ের কিছু পরেই আমরা পৌঁছে যাই অনুষ্ঠানের স্থানে। সকাল সাতটা থেকেই শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। পাঠভবনের সভাগৃহটি সুন্দর করে সাজানো ছিল পয়লা বৈশাখের ছোঁয়ায়৷ প্রবেশদ্বারে ছিল আলপনার কাজ, প্রাঙ্গণে লাল-সাদা কাপড়ে তৈরি প্যান্ডেল, আর দেয়ালে ছিল বাংলা নববর্ষ ও রবীন্দ্রনাথের পংক্তি লেখা রঙিন ব্যানার। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যেও ছিল উৎসবের আমেজ। অনেকে পাঞ্জাবি, শাড়িতে সেজে এসেছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন এক টুকরো বাংলার মেলা বসেছে পাঠভবনের ভিতরেই।
অনুষ্ঠানের সূচনা হয় একটি সম্মিলিত সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে - “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” গানের মাধ্যমে নববর্ষকে আহ্বান জানানো হয়। এরপর শুরু হয় একের পর এক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। গান, কবিতা, আবৃত্তি, এবং কখনো কখনো নৃত্য। সব মিলিয়ে এক বর্ণিল আয়োজন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছোট থেকে বড়, সব বয়সের মানুষ ছিলেন। তাঁদের সবার পরিবেশনাই ছিল আন্তরিক এবং প্রাণবন্ত।
এই অনুষ্ঠানে আমার কন্যা একটি বাংলা গান পরিবেশন করে। ওর কণ্ঠে ছিল আবেগ, ছিল একরকম অনাবিল আনন্দ যা দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। ও গাইছিল “মায়াবন বিহারিনী” - গানটির প্রতিটি শব্দ যেন মিলেমিশে গিয়েছিল অনুষ্ঠানস্থলের পরিবেশের সঙ্গে। আমি নিজেও মঞ্চে উঠি, এবং পাঠ করি আমার স্বরচিত একটি কবিতা, যার বিষয়বস্তু ছিল নববর্ষ, নতুন সম্ভাবনা, এবং হারিয়ে যাওয়া বাঙালিয়ানা ও আত্ম উপলব্ধি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা। কবিতাটি পাঠ করার সময় শ্রোতাদের যে মুগ্ধ দৃষ্টি অনুভব করছিলাম, সেটাই একজন কবির কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
প্রায় দু'ঘণ্টার পর ছিল প্রাতঃরাশের বিরতি। সে এক অন্যরকম আয়োজন! সকালবেলার ক্ষুধার্ত পেট যেন আনন্দে নেচে উঠেছিল ডালপুরি আর আলুর দমের গন্ধ পেয়ে। খাবারের তালিকায় ছিল দুটি গরম ডালপুরি, মশলাদার আলুর দম, আর শেষে মিষ্টির থালায় জিলিপি ও রসগোল্লা। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে খাবার পরিবেশন করছিলেন। সকলে একসঙ্গে বসে খাচ্ছিলেন। তাতে একধরনের পারিবারিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
প্রাতঃরাশের পর আবার শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। এবার মঞ্চে ওঠেন কয়েকজন প্রবীণ কবি ও শিল্পী। তাঁদের অভিজ্ঞতাপূর্ণ কণ্ঠে কবিতা ও স্মৃতিচারণ যেন সময়কে থামিয়ে রাখে। পাঠভবনের এক প্রবীণ সদস্য তুলে ধরেন বাংলা নববর্ষ পালনের ইতিহাস, এবং কীভাবে এটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর বক্তব্যে ছিল একধরনের আবেগ, যা শুনে আমরা বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের ঐতিহ্যের প্রতি আরও সচেতন হতে পারি।
অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে সবাই একসঙ্গে একটি দলগত ছবি তুললেন, যেখানে ধরা পড়ল আনন্দ, সম্প্রীতি আর সাংস্কৃতিক বন্ধনের সৌন্দর্য।
এই অনুষ্ঠানটি আমাদের জীবনে একটি দারুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে। শুধুমাত্র নববর্ষকে স্বাগত জানানো নয়, এই আয়োজনের মাধ্যমে আমরা যেন নতুন বছরকে সত্যিকার অর্থে হৃদয়ে ধারণ করলাম। কবিতা, গান, হাসি, খাওয়া-দাওয়া আর আন্তরিক মিলনের মাধ্যমে একটি দিন এমনভাবে কাটানো। এটাই তো বাঙালির আদর্শ নববর্ষ পালন।
আমি আর আমার কন্যা অনেকটা সময় ধরে সেখানে থেকেছি, শুধু অতিথি হয়ে নয়, এক ধরনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে। আমরা দেখেছি, উপলব্ধি করেছি, এবং উপভোগ করেছি।একটি বাঙালি সংস্কৃতির সজীব, প্রাণবন্ত রূপ। সত্যিই, এমন একটি দিন বছরের শুরুতে মনের ভিতরে একরাশ শান্তি ও আনন্দ ছড়িয়ে দেয়।
এইরকম অনুষ্ঠান যেন প্রতি বছর ফিরে আসে—এই কামনাই করি। কারণ এই আয়োজন শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি সংস্কৃতিকে ভালোবাসার উৎসব।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।