পুরনো সেই দিনের কথা। কিছু হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতিচারণ।

in আমার বাংলা ব্লগ2 months ago

পুরনো সেই দিনের কথা

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


pocket-watch-2061228_1280.jpg
সোর্স


🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏


বাসের ঠেলাঠেলি ভিড়ে তখন পকেটে হাত ভরে ভরে একটি বস্তুর অস্তিত্বের খোঁজ করতে হত না বারবার। দূর থেকে মহাসিন্ধুর মহাসংগীতের মত শব্দ ভেসে এলে উঁকিঝুঁকি দিয়ে হেলে পড়তাম এদিক ওদিক, হয়ত কারোর গায়েই। বস্তুটির নাম? আজ্ঞে মোবাইল ওরফে সেলফোন। আজ যার জোরে দুনিয়া ইধার কা উধার হয়ে যাবার উপক্রম। তবে ওপরের জমানাটি বড়ই উপভোগ্য ছিল জানেন। স্কুলের গেটে ছুট্টে গিয়ে সবটা শেষ হবার আগে ২০ পয়সার হজমি আর কারেন্ট নুন কেনার তাগিদ ছিল। টিফিনের সময়ে অফিসরুমে রাখা দুটি ব্যাটের একটিতে ভাগ বসানোর জন্য আগেভাগে দৌড়ে যাবার ব্যস্ততা ছিল। হাফপ্যান্টের পকেটে ঝোলা অ্যালুমিনিয়ামের কয়েনগুলো ওজনে বেশ হালকা ছিল বটে। কিন্তু বস্তুগত ভার ছিল অগাধ। আটআনায় খামে ভরা কাঠি বরফ হাতে নিলেই কাড়াকাড়ি করে অর্ধেকটা ধুলোয় ভূপতিত হতোই হতো। ও, দাঁড়ান দাঁড়ান চারআনা, আটআনার কথা মনে পড়েছে তো? আমার কাছে আজও একটা রয়েছে বৈকি। তবে ঘরে লোকজন এলে ঘটা করে আলমারির লকার থেকে কাগজের মোড়ক খুলে বের করে দেখাই। আবার কাগজে মুড়ে তুলেও রাখি। আর একখানা কথা, এই পয়সাটার সাথেই স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ভারতের একখানা কয়েনও তোলা আছে বাক্সে জানেন। ১৯৪৬ সালের। ওপরে এখনো ব্রিটিশরাজ ষষ্ঠ জর্জের প্রতিকৃতিটা স্পষ্ট। আরে ভাবছেন কেন হঠাৎ আটআনা থেকে জর্জে লাফ মারলাম? আসলে দুখানিই তো অ্যান্টিগ পিস আজ, তাই।

একটা গল্প বলি শুনুন। তখন রাস্তাঘাটে এদিকে সেদিকে চোখ পড়লেই কয়েকটি মহাজাগতিক খাঁচা দেখা যেত। গায়ে ঘটা করে লেখা থাকত PCO। পুরো অর্থ কী সেটা জানবার জন্য তিনজন দোকানদার কাকুকে জিজ্ঞাসা করেও সদুত্তর না পেয়ে শেষমেশ হাল ছেড়েছিলাম। কিন্তু গুগলের প্রয়োজনীয়তা তখনও বিন্দুমাত্র ঠাওর হয়নি, বিশ্বাস করুন। যাই হোক, মনে পড়েছে তো খাঁচাগুলোর কথা? ভেতরে ঢুকলেই এক পরম প্রশান্তি। কয়েক মুহূর্তের জন্য বহির্জগত থেকে একেবারে ধ্যানস্থ মৌনতা। বাইরে দাঁড়ানো লাইনটা কেমন অবাক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতো ভেতরের অঙ্গভঙ্গি করে মুখ নাড়ানো আপাত নির্বাক ব্যক্তিটির দিকে। আর স্কুল, কলেজ গেটের সামনে তো এগুলো থাকবেই। বলাই বাহুল্য, আমার কলেজের সামনেও ছিল। শেষ পিরিয়ডে ঘন্টা পড়বার আগেই ট্র‍্যাকহীন ম্যারাথনের সাক্ষী থাকতাম রোজ। গন্তব্য কেবলমাত্র সেই বায়ুশূন্য খাঁচাঘর, যার ভেতর থেকে একা নিশ্চিন্তে দুদণ্ড প্রাণের কথা বলে হালকা হওয়ার ভিড় লেগে যেত মানিব্যাগের ভেতর পকেটে লুকিয়ে রাখা ছবির মানুষটির সঙ্গে। এক মিনিট হয়ে যাবার আগে আগেই হাতে কয়েন নিয়ে তাক করে থাকতে হত নির্দিষ্ট জায়গায়৷ ধরাবাঁধা সময়ে সারাদিনের জমে থাকা কথা একনাগাড়ে উগরে দেবার তাড়াও ছিল রীতিমতো। আর দরজার বাইরে? ক্রমাগত ধাক্কার শব্দকল্পদ্রুম৷

ছিল না হোয়াটসঅ্যাপে 'আই লাভ ইউ' লিখেই মোবাইল ডাটা বন্ধ করে সেফজোনে অবস্থান করবার সুবিধে। ছিল না সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ভালোবাসার মানুষটার প্রতি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ অ্যাকশন রিপ্লে শোনার রেওয়াজও। কিন্তু যা ছিল তা আর নেই। ছিল কোচিং ব্যাচে পড়তে গিয়ে বারবার চোখে চোখ পড়ে যাবার রোমাঞ্চিত মুহূর্তগুলো। ছিল তিনমাস আড়ালে প্রবল গুঞ্জনের পরে প্রেমপ্রস্তাবটা সামনাসামনি পেড়েই ফেলবার জন্য বন্ধুদের ঠেলাঠেলি। আর ছিল বুকে বল সঞ্চয় করে ছাত্রবন্ধুর তিনশো কুড়ি নং পাতায় একটা প্রেমপত্র গুঁজে বই ফেরত দেবার প্রচলন। তাও পরের দিন স্কুলে গিয়ে অলিম্পিকে পঞ্চাশ কিলো বিভাগের একটা পেল্লায় থাপ্পড়ের আশঙ্কা সমেত। আর এইসবের নীরব সাক্ষী ছিল কারা বলুন তো? গোল্ড স্পট কোল্ডড্রিঙ্কসের খালি বোতল আর পপিন্সের রঙিন রঙিন দানাগুলো৷ বাড়িতে ছিল একটা দরজা খোলা টিভি। যেন সিনেমা হলের যবনিকার বনসাই সংস্করণ। যাও বা কাক, পায়রা তাড়িয়ে অ্যান্টিনায় শক্ত করে দড়ি বেঁধে চালানো যেত, ব্যাস, ছবি মোটে বাগ মানে না৷ পশ্চাৎদেশে অবস্থিত কানমোলার কল সেযাত্রায় ছবিকে দাঁড় করিয়ে দিত ঠিকই। কিন্তু শোলে ছবিতে জয়ের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পর থেকে প্রতিবারই অবধারিত ভাবে দ্বিগুণ গতিতে পুনর্মুষিকঃ ভবঃ। রিমোট হাতে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে চ্যানেল পাল্টানো ছিল না বটে৷ ঘরে বসে ওভালের ঘাসে পড়ে থাকা শিশির কণার এইচ-ডি ছবি ছিল না বটে। কিন্তু ছিল ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের দিন পাড়ার দাদা আর কাকুদের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারা। ছিল রবিবারের সকালে মহাভারতে দুঃশাসন বধের জন্য খাতাবই শিকেয় তুলে বিছানার সবচেয়ে প্রাইম লোকেশনটা আগে দখল করা। আর ছিল দাদু, দিদা, কাকা, মামা নামক কিছু অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের খিদে।

বিরিয়ানি অথবা পিৎজার নামই হয়ত জানা ছিল না। কিন্তু বাবার সাইকেলের সামনের সিটে বসে হাওয়ার দিকে ধরে ওড়াবার জন্য একটা রঙিন কাগজের ঘুর্ণির বায়না অবশ্যই ছিল। জানেন তো, স্কুলে পড়া না পারলে আমরা কখনও পানিশমেন্ট খাইনি। খেয়েছি শাস্তি। একেবারে ঘোরতর আসুরিক ঢঙে৷ বন্ধুদের সাথে নিত্য ঝগড়ায় মা চিরকাল নিয়েছে আমার বিপরীত পক্ষ। ভেবেছি আগাগোড়া শত্রুপক্ষের দায়িত্বশীল সেনাপতি। সেবার ক্লাস সিক্সে থাকাকালীন সৌরভের সাথে টিফিন টাইমে স্কেল নিয়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মহড়া দেবার পরে স্কেলরূপী শস্ত্রখানার দুটি টুকরো বাড়ি আনায় মায়ের কাছে প্রথম নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করেছিলাম এবং নিউটন সাহেবকে ভুল প্রতিপন্ন করে সমান্তরালে এও বুঝেছিলাম যে প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান তো নয়ই, রীতিমতো দ্বিগুণ প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। আমরা হয়ত সত্যিই ভাগ্যবান জানেন। আমরা দুটো কাগজের কাপে সুতো লাগিয়ে টেলিফোনে কথা বলেছি। আমরা তিনটে ইটকে সাজিয়ে উইকেট বানিয়েছি। নর্দমায় হাত ডুবিয়ে বল তুলে বারবার জামায় মুছেও নিয়েছি। আবার ফুটবল খেলার অজুহাতে জমিয়ে সারাগায়ে কাদা মেখেছি৷ কই হাতে পাঁকের গন্ধ অথবা জামায় কাদার দাগ হাজার খুঁজলেও তো আর খুঁজে পাই না। আর খুঁজে হয়ত পাবোও না জানেন। বড্ড তাড়াতাড়ি দাগগুলো তুলে ফেললাম না তো আমরা?


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

First_Memecoin_On_Steemit_Platform.png

hjh.png


Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 2 months ago 

Daily tasks-

Screenshot_20250211-083624.jpg

Screenshot_20250211-083453.jpg