💮সকলকে স্বাগত জানাই💮

কেমন আছেন সকলে? আজ একটা এমন বাড়ির কথা বলব যে বাড়ির কথা সাধারণ মানুষ খুব একটা জানেন না৷ অথচ আমি সময় পেলেই এই বাড়ির চাতালে গিয়ে বসে থাকি। সেখানে বসলে যেন এক নবজাগরণের আচ্ছন্নতা ভর করে নিজের ওপরে। সময়টা পিছিয়ে যায় এক ধাক্কায় দুশো বছর৷ আর বাংলার একটা আলোকিত অধ্যায় দখল নেয় নিজের মনের। সত্যিই এখানে দু দণ্ড বসবার অভিজ্ঞতা মনে রাখবার মত। এইতো সেদিনও, পৌঁছে গেছিলাম সেখানে। কিছুক্ষণ বসে কয়েকটি ছবি তুলে ফিরে এলাম ঘরে। সাথে করে নিয়ে এলাম একটা হারিয়ে যাওয়া সময় ও বাংলার গৌরবের কিছু স্মৃতি। কিন্তু আমি দেখেছি বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি হলেও এই বাড়ি ঘিরে মানুষের মধ্যে খুব একটা আগ্রহও নেই। আসলে আজ আর ইতিহাসে আগ্রহীই বা ক'জন৷ সবাই ব্যস্ত নিজের জীবনে। দৌড়ে বেড়ায় প্রাত্যহিক লড়াইতে। কিন্তু বাড়িটির প্রতি এই অবহেলার কারণ কী তা আমি সত্যিই আবিস্কার করে উঠতে পারিনি জানেন৷ অথচ এই বাড়িটি বাংলার পর্যটন মানচিত্রের উল্লেখযোগ্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারত৷

পাঠাগারের প্রবেশদ্বার

💮গৌরবের ইতিহাস💮

এবার বলব আমি কোন বাড়ি নিয়ে এতো গৌরচন্দ্রিকা করছি৷ কী এমন ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই নিরীহ বাড়িটার ইট কাঠ পাথরে। পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলায় অবস্থিত ছোট্ট জনপদ উত্তরপাড়া। আজ শহরতলির রূপ নিলেও ঊনবিংশ শতকে এই জায়গা ছিল বর্ধিষ্ণু জনপদ। উত্তরপাড়ার রাজা শ্রী জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের দক্ষ হাতে ছিল এই জনপদ। তখন তিনি এই শহরে বিভিন্ন স্থাপত্য ও নির্মাণ করে মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন৷ অবিবক্ত বাংলায় এমন বহু জমিদার বংশ ছিলেন যাঁরা প্রতিনিয়ত নিজের এস্টেট ও প্রজাদের সেবা ও হিতাহিতের কথা ভাবতেন। এক্ষেত্রে যশোরের রাণী ভবাণীর নামও উল্লেখযোগ্য। পরে কখনো রাণী ভবাণীকে নিয়েও কলম ধরব। বাংলার বিভিন্ন প্রাদেশীয় জমিদারদের ক্ষমতাও তখন ছিল অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আমরা মুঘল আমলে বারো ভুঁইয়ার কথাও বলতে পারি।

রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের প্রজাহিতৈষী কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা৷ এই পাঠাগার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার শিক্ষা মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তিনি চেয়েছিলেন মানুষ বই পড়ুক৷ আর শিক্ষিত হোক আধুনিক শিক্ষায়, ইংরাজি শিক্ষায়। সেই সময়টা বাংলার শিক্ষায় স্বর্ণযুগ। বিদ্যাসাগর সেই সময়েই সারা বাংলা ছুটে বেড়াচ্ছেন নারী শিক্ষা অগ্রগতির বিষয়ে। লড়াই করছেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে। আর যে সকল প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তাঁর এই লড়াইকে সমর্থন করেছিলেন, তারমধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের জন্য যে লড়াই, সেই হলফনামায় যিনি প্রথম সই করেছিলেন, তিনিই উত্তরপাড়ার রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর হাতেই তৈরি এই পাঠাগার। তৎকালীন স্থাপত্যের নিদর্শন আজও স্পষ্ট। বিল্ডিং আর্কিটেকচার সম্পূর্ণ গ্রীক কোরিন্থিয়ান স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত। সামনে লম্বা কোরিন্থিয়ান থাম। আজ রাস্তার ধারে যে অংশটি দেখা যায়, সেটি আসলে পাঠাগারের পিছন দিক। সামনের দিকটি গঙ্গার দিকে। গঙ্গার ধারে মনোরম পরিবেশে তিনি নির্মাণ করেন এই পাঠাগার। তারপর বহু ওঠাপড়ার সাক্ষী এই বাড়িটি। কে আসেননি এখানে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত সবাই কোনো না কোনো সময়ে এসেছেন এখানে৷ উত্তরপাড়ার রাজা আজ আর নেই৷ কিন্তু রয়ে গেছে তাঁদের অমর অক্ষয় কাজগুলো। আজ আমরা এই বাড়িগুলোকে আর কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব জানিনা৷ কিন্তু প্রতিটি বাঙালির আশু কর্তব্য, পুরনো বাংলার ঐতিহ্য ও সম্পদগুলোকে সাধ্যমতো বাঁচিয়ে রাখা। বাংলার ইতিহাস মানচিত্র মুছে গেলে মুছে যাবে একটা সম্পূর্ণ জাতি৷ বাঙালির হৃদয় আজও মিশে আছে মধ্যযুগীয় বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রে। তাই সবসময় মনে করি, কংক্রিটের জঙ্গলে হারাতে হারাতে আমরা যেন কালের গর্ভে না হারিয়ে যাই।

প্রাচীন কোরিন্থিয়ান থাম ও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য

এবার আসি এই বাড়িটির ঐতিহ্যে। প্রথমত মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন বিলেত থেকে ফিরে প্রায় কপর্দকশূন্য, তখন তাঁর অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছিলেন তাঁর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিলেতেও তিনি ধার করে হলেও টাকা পাঠাতেন মাইকেলকে। কারণ তিনি জানতেন মাইকেলের মত বাঙালি প্রতিভা প্রায় বিরল। অর্থাভাবে বিদ্ধ মাইকেল দেশে ফেরার পরেও তাই তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগর। অর্থহীন, গৃহহীন মাইকেলের একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেবার জন্য তিনি অনুরোধ করলেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়কে। আর বিদ্যাসাগরের কথা ফেলবেন এমন মানুষ রাজা জয়কৃষ্ণ নন। তাই উত্তরপাড়া পাঠাগারের দোতলায়, গঙ্গার দিকে একটি ঘর তিনি দিলেন মাইকেলকে। সেখানেই কিছু বছর কাটিয়েছিলেন মধুকবি। আর সেই স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির সিঁড়িতে বসে থাকতে থাকতে যেন কোথায় হারিয়ে যাই আমি। এখনো সেখানে গেলে দোতলার ঘরটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবি, না জানি জীবনের কত লড়াই একা এখানে লড়েছিলেন বাঙালির এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

উত্তরপাড়া পাঠাগার থেকে সংগৃহীত বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছবি

এছাড়াও এই বাড়িটির আরো এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন মুজাফফরপুরে অত্যাচারী কিংসফোর্ড সাহেবকে বোমা মারতে গিয়ে ধরা পড়লেন ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকী, তখন তাঁদের মূল নেতা ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ৷ ফলতই ইংরেজ পুলিশের তুমুল ধরপাকড়ের পর মানিকতলা থেকে ধরা পড়েছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীণ ঘোষরা। সাথে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীও। তখনই শুরু হয় বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা। এরপর মামলা শেষে অরবিন্দ বেকসুর খালাস পাবার পর এই উত্তরপাড়া পাঠাগারের মাঠেই প্রথম জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন৷ প্রচুর মানুষ এখানে জড়ো হয়েছিল সেদিন তাঁর মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্য। তারপর তিনি পন্ডিচেরি চলে যান এবং সেখানে আশ্রম স্থাপন করেন। তাই সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই স্থাপত্য বাঙালির ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য তীর্থ। বহুযুগে বহু বিশিষ্ট মানুষ বারবার এসেছেন এখানে।

আমার বাড়ির সন্নিকটেই এমন ঐতিহাসিক স্থাপত্য থাকলে কেনই বা মাঝেমাঝে আসব না এই পুণ্যভূমিতে। এখানে এলে নিজেকে যেন স্নান করিয়ে নিতে পারি শুদ্ধতার পবিত্রতায়। এ যেন সময়ের চাকায় নিজেকে মিশিয়ে এক পবিত্র গন্তব্যে হেঁটে চলা।

আজ উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাঠাগারে আমার কাটানো সময়গুলো আপনাদের সামনে তুলে আনতে পারে নিজেরই খুব ভালো লাগছে। ইতিহাস কখনো মোছা যায় না। তাই বাংলা ও বাঙালির এমন ঐতিহ্যগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য দুই বাংলার মানুষের কাছেই আমার আবেদন রইল। আসুন ঐতিহ্যকে রক্ষা করি। যে যার জায়গায় বাঁচিয়ে রাখি বাঙালির গৌরবের সেই দিনগুলো।

উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ সাধারণ পাঠাগার

প্রতিষ্ঠাকাল	১৮৫৯
প্রতিষ্ঠাতা	রাজা জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
স্থান	উত্তরপাড়া, হুগলি
বর্তমান মালিকানা	পশ্চিমবঙ্গ সরকার
ছবি তোলা হয়েছে	ইনফিনিক্স হট ৩০ মোবাইল

---

---

--লেখক পরিচিতি--

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

---

---

কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

---