মানসিক আঘাত মানুষকে একা করে দেয়। তখনই সমাজে প্রয়োজন পড়ে অভিনয়ের। জেনারেল রাইটিং।
একার অভিনয়ের আড়ালে ক্লান্ত মানুষের লড়াই
মানুষ একটি সামাজিক জীব, কিন্তু বাস্তবে মানুষ বড় একা। এই একাকীত্ব শুধু শারীরিক নয়, তা মানসিক স্তরে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। যখন মানুষ একের পর এক মানসিক আঘাতে জর্জরিত হয়, তখন তার ভিতরের শক্তি, সাহস, সহ্যক্ষমতা। সব কিছু একে একে নিঃশেষ হতে শুরু করে। বাইরের দুনিয়ার কাছে সে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে, হাসে, কথা বলে, দায়িত্ব পালন করে; কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে ভেঙে পড়ে।
এই অভিনয়ই ধীরে ধীরে এক ধরণের মানসিক ক্লান্তি তৈরি করে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দিনের শেষে যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসে, তখন মানুষ নিজেকে আর লুকোতে পারে না। তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু সে নিজে, তার না বলা কষ্ট, তার ভাঙা মন, আর একরাশ অব্যক্ত হতাশা।
মানসিক আঘাত কোনো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তার যন্ত্রণা শারীরিক যন্ত্রণার থেকেও ভয়ংকর। মানুষ একবার, দু’বার আঘাত পেলে সহ্য করতে পারে, কিন্তু বারবার অবহেলার মুখোমুখি হতে হতে সেই সহ্যশক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রিয়জনের অবহেলা, কাছের মানুষের অস্বীকৃতি, সমাজের কটূক্তি। সব মিলিয়ে এক জটিল যন্ত্রণার ভার বহন করে মানুষ। কিন্তু সেই কষ্ট ভাগ করার কেউ থাকে না।
এই সময় মানুষ চুপচাপ হয়ে যায়, কম কথা বলে, অনেক সময় হাসিমুখে লুকিয়ে রাখে নিজের সব ভাঙন। অথচ তার হৃদয়ের ভিতরে তখন চলতে থাকে এক নিরন্তর যুদ্ধ। সে বোঝে, কেউ তাকে পুরোপুরি বুঝবে না, তাই নিজের মনের সাথে নিজেই কথা বলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তৈরি হয় এক অভ্যন্তরীণ জগৎ, যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
এই মানসিক লড়াইয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে প্রশ্ন করতে থাকে নিজের অস্তিত্বকে, জীবনকে, এমনকি ভালোবাসাকেও। অনেকেই মনে করে, এই যন্ত্রণা চিরকাল থাকবে, তাই তারা নিঃশব্দে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ, ভেতরে প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যেতে থাকে সে।
নিজের অনুভূতিগুলো যখন অন্যের কাছে রসিকতার পর্যায়ে চলে যায় তখন মানসিক ভাবে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। সম্পর্কের গভীরে লুকিয়ে থাকে এক অবিচ্ছেদ্য নির্ভরশীলতা। আর যখন বোঝা যায় সেই নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে রুক্ষ জমিতে পরিণত হচ্ছে, তখন নিজের কাছে প্রশ্ন করার মতও কোনো ভাষা থাকে না। কখনো কখনো মনে হয় নিজের কাছেই আমরা নিজেকে লুকিয়ে ফেলি। যাতে বাইরের পৃথিবীর সামনে শুধুমাত্র নিজের খোলসটুকু প্রদর্শন করা যায়।
নিজের কাছে নিজেকে গ্রহণ করা, নিজের কষ্টকে স্বীকৃতি দেওয়া এক্ষেত্রে ভীষণ উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই প্রক্রিয়াই ধীরে ধীরে শক্ত করে তোলে। তখন অভিনয়ের দরকার পড়ে না, কারণ সে জানে, নিজের অনুভবকে ঢাকতে নয়, তাকে সম্মান জানাতে হয়।
মানসিক আঘাত থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ বুঝবে৷ সে একা নয়, তার কষ্টের গুরুত্ব আছে৷ ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই চলবেই। আর এই লড়াইয়ের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন আমি, এক দৃঢ়, সাহসী সত্তা। হয়তো সেই নতুন নিজেকে চিনতেও অনেক সময় অসুবিধা হয়ে যায়।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
খুব সুন্দর লিখেছ। তোমার পর্যালোচনা দেখে অভিভূত হলাম৷ প্রতিটি লাইন মনযোগ সহকারেই পড়লাম।
কবিরা মনঃস্তাত্ত্বিক আলোচনা করতে পারেন। কারণ তাঁদের সেই বোধ আপনে আপই তৈরি হয়। তেমনি তোমার লেখাটাও ওই জায়গাটি ছুঁয়ে যায়৷ অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি লেখা শেয়ার করার জন্য।
https://x.com/KausikChak1234/status/1914329114263318745?t=XXIQT3SzSHsIqMQXt856Pw&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1914330428971815180?t=EgB8KgFBsAGvQH8MVH6UEw&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1914330995030884852?t=lJwhVPzMH4CBkhHyzKJFvA&s=19