মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। জাতিসত্তা সংরক্ষণে মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটা? একটি আলোচনা।
।। মাতৃভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ।।
🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏
মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। এই কথার গুরুত্ব অনেক। আসলে আজকালকার দিনে মাতৃভাষার গুরুত্ব যেন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কখনো এই বিষয়ে পর্যালোচনা করিনি যে মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব ঠিক কতখানি। জীবনে মায়ের গুরুত্ব ঠিক যতটা, মাতৃভাষাও তার থেকে কোন অংশে কম নয়। আমরা আজকালকার বাঙালি হয়েও যেন বাংলা ভাষাকে ভুলতে বসেছি। তাই সেই দিক থেকে ভাবতে হলে মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে অবশ্যই চিন্তা ভাবনা করা উচিত। মানুষের জীবনে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। কিন্তু কেন? কী আছে এই মাতৃভাষার ভিতরে? আসলে যে ভাষায় আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং যে ভাষায় মা কথা বলেন, সেই ভাষা এবং ভাষাভাষীদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। একটি ভাষা তখনই মৃত ভাষায় পরিণত হয় যদি সেই ভাষায় আর কেউ কথা না বলে। তাই যে কোন ভাষা যাতে মৃত ভাষায় পরিণত না হয় তা দেখা মানুষের একান্ত কর্তব্য। বিশেষ করে নিজের মাতৃভাষা যদি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যায় এবং লুপ্ত ভাষায় পরিণত হয় তবে তার থেকে লজ্জার আর কিছু নেই। যে ভাষায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা শূন্য, তাকে মৃত ভাষা বা লুপ্ত ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বাংলা আসলে একটি নব্য গঠিত উপভাষা। আমরা অনেকেই জানি যে মগধের প্রাচীন ভাষা মাগধী প্রাকৃত থেকে আমাদের এই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। যার উৎপত্তিস্থল হিসাবে আদি চর্যাপদ ও মৈথিলী ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়। তাই এক্ষেত্রে বিদ্যাপতিকে বাংলা ভাষার একজন উৎকৃষ্টতম কবি হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু বিদ্যাপতি আসলে মৈথিল কবি হিসেবেই বিখ্যাত। তবু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিদ্যাপতির অবদান অনস্বীকার্য। আর এই প্রায় হাজার বছরের ভাষা বাংলার বর্তমান উপধারাটি যদি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই, তবে অবিলম্বেই এই ভাষার প্রতি যত্নশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে না রাখতে পারলে, অচিরেই সেই ভাষাও একটি লুপ্তপ্রায় ভাষায় পরিণত হবে। ঠিক যেমন করে বর্তমানে দেবনাগরী ভাষা বা সংস্কৃত ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা আর প্রায় নেই। আর তাই এই ভাষাটি ভারতবর্ষের আদি ভাষা হলেও বর্তমানে তা বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠেছে। বাংলা ভাষায় সারা পৃথিবীর এক বিপুল সংখ্যক মানুষ কথা বলেন। কিন্তু বর্তমানে এই ভাষাও ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত। কোথাও উর্দু শব্দ দিয়ে আবার কোথাও হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে আমরা বাংলা ভাষাকে আসলে কি কলুষিত করছি না? প্রকৃত বাংলা বলে যেটুকু আজ বেঁচে আছে, তার মধ্যে বহু শব্দই তদ্ভব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন বিদেশি ভাষা থেকেও বহু শব্দ এসে অনবরত যুক্ত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। আর এভাবেই দিনে দিনে শব্দকোষ বৃদ্ধি পায় একটি ভাষার। কিন্তু এই বিদেশি শব্দের আধিক্য যখন গ্রাস করে নেয় একটি ভাষার নিজস্বতাকে, তখন সেই ভাষার কাছে তা খুবই বিপদজনক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যবহৃত বাংলা ভাষাটি কতটা প্রাচীন বাংলাকে ধরে রাখতে পারছে তা কিন্তু তর্ক-সাপেক্ষ। আজকালকার প্রজন্ম শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে অনেক প্রতিবন্ধকতার সামনে পড়ছে৷ সেক্ষেত্রে মাতৃভাষার থেকেও তারা হিন্দি বা ইংরেজি ভাষায় বেশি সাবলীল। আসলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে এক অন্ধকার কূপে ঠেলে দিচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে পেশাদার জীবনে প্রবেশের জন্য আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিদেশি ভাষার চর্চা করে নিচ্ছি, কিন্তু পক্ষান্তরে আমরা বাংলা ভাষাকে বা মাতৃভাষাকে ঠেলে দিচ্ছি গভীর অন্ধকারে। আজ হিন্দি বাক্যকে বাংলায় আক্ষরিক অনুবাদ করে বলবার একটা প্রচলন খুব দেখা যায়। আর যা ভীষণভাবে ক্ষতি করছে প্রকৃত বাংলা ভাষাকে।
একটি ভাষা আসলে একটি জনজাতির প্রধান মুখ। আর সেই ভাষা দিয়েই সেই জাতিকে পৃথিবীর মানচিত্রে চিহ্নিত করা হয়। তাই একটি স্বতন্ত্র জাতিকে যদি কোন কিছু দিয়ে চেনা যায় তা হল একমাত্র ভাষা। এই সেল্ফ আইডেন্টিটিটুকু আমরা যদি নষ্ট করে ফেলি, তবে সম্পূর্ণ জাতি একসময় বিপন্নতার মুখে পড়ে যায়। যেভাবে আমরা অন্য ভাষায় সাবলীল হয়ে উঠছি এবং নিজের মাতৃভাষাকে দূরে ঠেলছি, তা কখনোই একটি উন্নত জাতির জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সূচিত করে না। তাই মানব সমাজের এক উন্নত এবং গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই মাতৃভাষাকে আমাদের সযত্নে লালন করা উচিত নয় কি? নিজের মাতৃভাষা হারিয়ে ফেললে হয়তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি জাতিসত্তাও হারিয়ে ফেলবো। আর তখন নিজেদের বাঙালি বলতে দুবার ভাবতে হবে পৃথিবীর বুকে। ফরাসি ভাষা যেমন প্রিয় ফরাসিদের কাছে, স্প্যানিশ যেমন প্রিয় স্পেনে, ঠিক তেমন বাংলা প্রিয় হওয়া উচিত আমাদের বাংলায়। দুই বাংলার বাঙালি যদি নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে একজোট না হয় তবে পৃথিবীর বুকে এই নব্য স্বতন্ত্র ভাষাটি যে ধীরে ধীরে বিপন্নতার মুখে পড়বে তা বেশ সহজেই বোঝা যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে, উন্নতি হয় মানব সমাজের। কিন্তু অপরিবর্তিত থাকে ভাষা। হয়তো কিছু অত্যাবশক পরিবর্তন সেই ভাষাকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তোলে। কিন্তু তা কখনোই ঠেলে দেয় না বিপন্নতার মুখে। এ কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে হবে মাতৃভাষার গুরুত্ব। আর যদি আমরা তা না পারি, তবে নিজেদের সত্তাটুকু নিজস্বতায় রাঙিয়ে তুলতে পারব না। বাকিটুকু আপনারা ভাবুন। সকলে মিলে ভাবলে নিশ্চয় আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1881781095173357842?t=hlIeNlwAmTgPFSOn-brMZg&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Daily tasks-