রবীন্দ্রনাথ ও প্রেম। একটি তাত্ত্বিক আলোচনা।

in আমার বাংলা ব্লগlast month

রবীন্দ্রনাথ ও প্রেম। একটি তাত্ত্বিক আলোচনা।

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


tagore-1105201_1280.png
সোর্স


🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏


মার্কিন ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস বলছেন "একজন কবি ও সৃজনশীল সাহিত্যিক যা কিছু লেখেন, তার প্রতিটি পংক্তিতে তার নিজের কথাই লেখা থাকে।" যদিও রবীন্দ্রনাথ একথা কোনোদিনই মানেননি। রবীন্দ্রনাথ বাউলহৃদয়। তাঁর কলমে বারে বারে ঝরে পড়েছে বাউলমনস্কতা আর প্রকৃতিপ্রেমের অপ্রাকৃত পর্যায়গুলো। কবি ছিলেন নাছোড় প্রেমিক। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কবি পূজা ও প্রকৃতিকেও প্রেমের সাথে একাত্ম করেছেন। তাইতো প্রেমিক কবিকলম কখনো বলছে –

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে —

দীর্ঘ কবিজীবনে প্রেমের পর্যায়গুলো তুলে আনতে হলে কবির প্রেমিক সত্ত্বাটা ছুঁয়ে দেখা বড়ই প্রয়োজন। সাত বছর বয়সে নয়বর্ষীয় নতুন বৌঠান কাদম্বরী থেকে প্রোঢ়ত্বে কিশোরী রাণু- একাধিক প্রেমিকা কবিকে পুড়িয়েছেন অনবরত। প্রেমের কিবা ধারা, কিইবা আহ্লাদ। প্রেম যে নিখাদ সুক্ষ মননকাব্য- তা বারেবারে উঠে এসেছে কবির দগ্ধ কলমে। এমনকি রবিজীবনে বারবার দেখা যায় একাধিক অসমবয়সী প্রেমিকার সান্নিধ্য। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য মহাশয় এই অসমবয়সী সম্পর্কের উপর সম্প্রতি তিনি তাঁর একটি লেখায় লিখছেন--
“অসমবয়সী রানু ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। শিল্পপতির পুত্র বীরেন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়ে গেলে রানু-রবীন্দ্রের দীর্ঘ আট বছরের প্রীতি- ভালবাসার মধুর সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় রানুর বয়স উনীশ। ১৯১৭-তে পরস্পরের পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যখন দুজনের একটি সম্পর্কের ভিত্তিভূমি রচিত হচ্ছিল তখন রানুর বয়স এগারো, আর সেই সময় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের বয়স ছাপ্পান্ন। ‘প্রিয় রবিবাবু’ কে রানু বলে,

কেও জিজ্ঞাসা করলে বলবেন আপনার বয়স ‘সাতাশ’।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলেন , -আমার ভয় হয় পাছে লোকে সাতাশ শুনতে সাতাশি শুনে বসে।

পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমন্তবালা রায় চৌধুরীর সম্পর্কের কথাও তুলে এনেছেন রবীন্দ্রজীবনী গবেষকরা। এমনকি ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার জন্যও রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা ছিল এমনটাও শোনা যায়। ইন্দিরা বয়সে ছোট হলেও মনের দিক থেকে ছিলেন পরিণত। কবির বেশ কিছু চিঠি পড়েই সেটা স্পষ্ট হয়। স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গেও কবির জীবন ছিল সরল, স্বাভাবিক। সেখানেও প্রেমের ছোঁয়া এতটুকু কম পড়েনি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অতল প্রেমপর্যায়ের সাধক। তিনি পুড়তে ভালোবাসতেন আর পোড়াতেনও অহরহ। তাঁর প্রেমের সূক্ষতা আজও অবাক করে রবীন্দ্র গবেষকদের। প্রতিটি সম্পর্কের অভিঘাতে রবি যেন বারেবারে প্রকাশিত হয়েছেন প্রেম ও কল্পনায়।

বিলেত যাত্রার আগে বোম্বেতে কবি উঠেছিলেন মারাঠি আত্মারামের বসতে। তাঁর কন্যা আন্না তড়খড় খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের অজান্তেই যেন ছুঁয়ে যান কবিহৃদয়। এমনকি শোনা যায় পরে আত্মারাম কলকাতায় দেবেন্দ্রনাথের কাছে আসেন রবির সাথে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়েও। কিন্তু রক্ষণশীল দেবেন ঠাকুর অসবর্ণ বিবাহে যে মত দেবেন না তা অবাক হবার মতো কোনো বিষয় ছিল না।

রবিপ্রেমের অন্য একটি পর্যায় মিশে আছে আর্জেন্টিনার প্লাতা নদীর গা ঘেঁষে। রবি তখন নোবেলজয়ী, বিশ্বকবি। সারা দুনিয়া তাঁর 'গীতাঞ্জলি'তে বিমোহিত। আর্জেন্টিনায় থাকাকালীন কবির সান্নিধ্যে এলেন তরুণী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ক্রমেই কবির কাছে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মোপলব্ধির ভাগটুকু। অনেকে বলেন

আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী"-

গানটি ওকাম্পোর উদ্দেশেই রচিত, যদিও তা নিতান্তই গুজব বলে ধরা যায়। কারণ গানটি লেখা হয় ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে আর রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনা যান ১৯২৪ সালে।

প্রেমের প্রতিটি স্তরে যেন রবি ধরা দেন বহু অচেনারূপে। তাঁর বাউলমন কখনো নারীসৌন্দর্যকে যেমন অস্বীকার করতে পারে নি, ঠিক তেমনই আবার স্থূল দৈহিক প্রেমে তাঁর বিশ্বাস ছিল না কোনোদিনই। একটা সময় জোড়াসাঁকোর অন্দরে বৌঠান কাদম্বরী হয়ে ওঠেন কিশোর রবির সাহিত্যকর্মের প্রধান সমালোচক ও পৃষ্ঠপোষক। একটি কবিতায় তিনি লিখছেন –

তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা ॥

প্রথম দিকে সাহসী রবিকে আমরা কবিতার ' চুম্বন' বা 'স্তন'এর মতো শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু তাঁর কবিতায় কখনো ধরা পরে নি প্রেমের স্থূল অবয়বটি। তিনি প্রেমকে সন্তর্পনে ধরে রেখেছেন নিরাকার শূন্যতার চাদরেই।

বয়স যাই হোক, শান্তিনিকেতনের প্রৌঢ় রবিও ছিলেন দামাল যুবক। এডওয়ার্ড টমসনকে কবি নিজেই এক সময় চিঠিতে বলছেন,

আমি সেদিন পর্যন্ত ষাট বৎসরের পূর্ণ যৌবন ভোগ করছিলুম।

রাণু রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছে-

আমি আপনার কে?

নিজেই বলেছে ,

আমি আপনার বন্ধুও নই। আর কেউ জানবেও না।

এই চিঠিতেই রাণু লিখছে –

আমি কাউকেই বিয়ে করব না – আপনার সঙ্গে তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সে আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল। সেই সিক্রেট টুকুতে তো কারুর অধিকার নেই।

শেষপর্যন্ত অবশ্য রাণু বিবাহে সন্মত হয় ও এই চিঠির সাত মাস পরে রাণু-বীরেন্দ্রের বিবাহ হয়।

পরবর্তীতে রাণু-হীন শিলং আর কবির ভালো লাগে না। ১৯২৮ সালে কবি শিলংয়ের পটভূমিতেই লিখতে শুরু করেন অমিত-লাবণ্যের প্রেমের উপন্যাস 'শেষের কবিতা'। আদপেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা কখনো শেষ হবার নয়। তার প্রেমিকমনের নির্যাসটুকু তিনি যেন খুব আদর করেই মাখিয়ে দিয়ে গেছেন অমিত, লাবণ্যদের শরীরে। রবিপ্রেম এক সারল্যের দুনিয়া। আজও বহু রবীন্দ্র গবেষক তাঁর হৃদয়কে ভাঙছেন গড়ছেন নিজেদের মতো করে। কবির যেমন মৃত্যু নেই, ঠিক তেমনই কবির হৃদয়েরও প্রৌঢ়ত্ব নেই। তাঁর সার্ধশতবার্ষিক যুবক মন আজও আমাদের দোলায়, ভাসায়।


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

6VvuHGsoU2QBt9MXeXNdDuyd4Bmd63j7zJymDTWgdcJjo1LsUc8S2zjHiaW6UcX2M5SAfbrPcxiCjQzCc6aZJSjUDgt85bSStrwGCUjZMWCDKxNata4NQ2cZTKGxsY.png

FrDSZio5ZCzUamf35asauSgs1tnNGCc8exBrDii52qi3JpjTyYCF9oFoYfs1EV4VTnFw6faxzt5X7uHiwMAHmLS3ef2Jb2JcxHBkpRBd2y...Qa3Q3c7Biv4c8mKsr8DHNVYqqpVomFSv1wmkMCbhs7oCjb14sjkA3vxAfSRk8QPzNZ5UirrZUzvHCXygHCV49RVVZBeTFCeo47WcQXnjLYGy2RNdJQycJW4cN.jpeg

2N61tyyncFaFVtpM8rCsJzDgecVMtkz4jpzBsszXjhqan9xBEnshRDSVua5J9tfneqYmTykad6e45JWJ8nD2xQm2GCLhDHXW9g25SxugWCoAi3D22U3571jpHMFrwvchLVQhxhATMitu.gif


Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

 last month 

Daily tasks-

Screenshot_20250302-005052.jpg

Screenshot_20250302-004842.jpg

 last month 

রবীন্দ্রনাথের প্রেম শুধু ব্যক্তি-নারী কেন্দ্রিক ছিল না, বরং তা ছড়িয়ে ছিল প্রকৃতি, সঙ্গীত, সাধনা, দর্শন ও আত্মিক উপলব্ধির প্রতিটি স্তরে। তিনি প্রেমিক, কিন্তু সেই প্রেম কখনোই একরৈখিক নয়; বরং তা বহুমাত্রিক, একধারে গভীর, অন্যধারে অতি সূক্ষ্ম। তাঁর সম্পর্কগুলো যেমন ব্যক্তিগত আবেগে পূর্ণ, তেমনই সেগুলো এক ধরনের সৃষ্টিশীল তপস্যার অংশ। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের অধ্যায় শুধু জীবনের গল্প নয়, তা এক অনন্ত অনুভূতির সুরেলা বহিঃপ্রকাশ। আপনার পোস্টটি পড়ে ভালো লাগলো ধন্যবাদ দাদা।

 last month 

একদম ঠিক কথা বলেছেন আপু। রবীন্দ্রনাথের প্রেম আসলে বৃহৎ অর্থে প্রেম। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেমকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে গেছেন তাঁর লেখায়। তার প্রেমের ব্যাখ্যা পাওয়া যেন আমাদের এক জীবনে কখনোই সম্ভব নয়।