ঈশ্বরের নিজের দেশ কেরালা পর্ব -৮ (কোচি থেকে আলেপ্পি)
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
কোচিতে থাকাকালীন দ্বিতীয় দিন আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম আলেপ্পির উদ্দেশ্যে৷ অনেকেই কোচি থেকে আলেপ্পি বাসে বা গাড়ি ভাড়া করে যান। আমরা গিয়েছিলাম কাক ভোরে ট্রেনে। হোটেল থেকে বিশেষ কিছু খাবার দাবার না নিলেও সামান্য স্ন্যাকস আর জল সাথে বেরিয়ে পড়লাম আলেপ্পির উদ্দেশ্যে —ভোরের আলো তখনও আকাশ ছুঁয়ে ওঠেনি ঠিকমতো, নিঃশব্দে ঘুমন্ত শহরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলা এক মন্থর যাত্রা।
সকাল সাতটা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই আলেপ্পি স্টেশনে৷ সেখান থেকে অটোতে করে ব্যাকওয়াটার ঘাটে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে নারকেল পাতার ফিসফাস, দূরে কারও হালকা সাঁতারের আওয়াজ। ছোট্ট একটা বোট যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল— এত সকালে খুব একটা বেশি লোকের কোলাহল নেই তাই আমরা অনেকটাই বার্গেনিং করতে পেরেছিলাম। তা না হলে এই সময় বোটের খরচ কিন্তু অনেক বেশি থাকে। প্রায় চার ঘণ্টার জন্য বুক করে নিয়েছিলাম। সূর্য মাথার উপর গন গন করবে সে কথা ভেবে খুব একটা দেরি না করে চট জলদি আমরা ওই বোটেই চেপেই যাত্রা শুরু করলাম।
শহরের ধুলো, ট্রাফিক, শোরগোল যেন এক লহমায় মুছে গেল। চারপাশটা যেন ছবির মতো—জল টলটলে, একটুও নাড়াচাড়া নেই, তাতে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে লম্বা নারকেল গাছ, দু-একটা সাদা বক জলের কিনারে ঠায় দাঁড়িয়ে, আর পাড়ে ঘরবাড়ির দেউড়ি থেকে ভেসে আসা রান্নার গন্ধ।
বেশ অনেকটা পথই আমরা ভেতরের ক্যানেল দিয়ে যাচ্ছিলাম মূল লেকে যাওয়ার জন্য। যে সমস্ত বটে রাত্রি বাস করা যায় তারা সকলে ফিরছে ফলে আমরা অনেক বড় বড় হাউজবোট দেখতে পেলাম। সকালের নীল আকাশ আর এই শান্ত পরিবেশ সব মিলিয়ে অপূর্ব এক নিস্তব্ধতার ভেতর কি যে মারাত্মক প্রশান্তি কাজ করছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।
বেশ কিছুক্ষণ বোট চলার পর আমাদের থামানো হলো এক লেকের ধারের গ্রামে। সেখানেই পাওয়া গেল সকালের জলখাবার—তুলতুলে, ভেজা-ভেজা গরম আপ্পাম, সঙ্গে নারকেলের দুধে রান্না করা ছোলার তরকারি। ঝাঁঝ নেই, কিন্তু অদ্ভুত স্বাদ—একধরনের মাটি ও প্রকৃতির গন্ধমিশ্রিত। তার সঙ্গে পাওয়া গেল কেরালার ঘন, কালো কফি—যা মুখে দেওয়া মাত্র বোঝা যায়, এর তলায় কোথাও এলাচ বা তেজপাতার সুবাস মিশে আছে। ভোরের হাওয়া, সেই সামান্য কাঠের বেঞ্চে বসে, সামনে থেমে থাকা শান্ত নদী আর হাতে গরম কফির কাপ—সেই মুহূর্তটা একরকম সময়হীন হয়ে উঠেছিল।
বাচ্চাদের ভালো লাগবে সে কথা ভেবে ছোট ছোট ঈগল পোষ মানিয়েছে এখানকারই কিছু লোক এবং সেইগুলো ঘাড়ে মাথায় বিভিন্ন জায়গায় বসে পোস্ট দিচ্ছে আর ছবি তুলছে। এটাও এক ধরনের জীবিকা। তো আমার মেয়ে সচরাচর তো কিছু যায় না তাই পাখির সাথে ছবি তুলবে বলতে আমি আর না করলাম না। বেশ কয়েকটি সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছি।
এরপর আবার ভোটে করে যাত্রা শুরু হয় এবং আমরা যেন লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাই। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে এই বিশাল আকারের লেকের মধ্যে ঘোরাফেরা করি এবং নানান ধরনের হাউজ বোট দেখি। সেখানে অনেকে ওয়াটার স্পোর্টস করছিল। যতদূর চোখ যায় ততদূর এই প্রকাণ্ড জলরাশি আমাদের চোখ এবং মাথার ক্লান্তি একেবারেই দূর করে দিচ্ছিল। কেউ যদি বলে না দিত আমরা হয়তো বুঝতেই পারতাম না এটা কোন বড় লেক আমাদের বারবারই মনে হচ্ছিল যেন একটা শান্ত সমুদ্রের উপর আমরা রয়েছি। আসলে এই লেকটা কে বলা হয় ব্যাক ওয়াটার। এখানে অনেক মাছ রয়েছে অনেকে এখানে মাছ ধরেন। সর্বোপরি মজার ব্যাপার হল এটাও একটা জলজ পথ। এই পথেই সরকারি বোট যাতায়াত করে এবং মানুষ দৈনন্দিন যাতায়াতও তো করে।
আলেপ্পির এই গ্রামগুলোতে কোন রোড নেই এবং কোন মোটর ভেহিকেল চলে না। একেবারেই মোটরগাড়ি বিহীন বা যেকোনো ধরনের পেট্রোল চালিত গাড়ি বিহীন গ্রাম ভারতবর্ষে এরকম গ্রাম কোথায় আছে এখনো পর্যন্ত জানা নেই। আর এই কারণেই বোধহয় এখানে আকাশ এতখানি নীল।
৪ ঘন্টা সময় ফুরিয়ে যাবার শেষের দিকেই আমরা ফিরে এলাম যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। যখন ফিরে এলাম তখন মাথার ওপর সূর্য গনগন করছে। যেহেতু আমাদের ফেরার ট্রেন বিকেল বেলায় পাঁচটায় তাই আমাদের হাতে অনেকটাই সময় । কারণেই সবাই মিলে ঠিক করলাম লাইট হাউস দেখতে যাব।
আবারো অটো বুক করে চলে গেলাম লাইট হাউসের সামনে। রোদ তখন গনগনে—চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সাদা আলো চারপাশে, শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। তবু লাইট হাউসে উঠব বলে মনে ছিল একরকম তৃষ্ণা। গোল সিঁড়ি, একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ওপরে ওঠা—হাওয়ার রাস্তা বন্ধ, ভেতরে গরম জমে আছে, কিন্তু প্রত্যেক ধাপে ধাপে যেন বাড়ছে উত্তেজনা। প্রায় সাত তলা বাড়ির সমান এই লাইট হাউস। আমি আর আমার মেয়ে গুটি গুটি পায়ে অবশেষে ওপরে উঠে চারপাশে চোখ মেলে ধরতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তা ভাষায় বোঝানো মুশকিল। সমুদ্র, ব্যাকওয়াটার, রেললাইন, খেজুর-নারকেল বনের ক্যানভাস একসঙ্গে মিলে গেছে। ওপরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা যেন এক সুবিস্তৃত জলছবি, আর আমি সেই ছবির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি, —শুধু প্রকৃতি আর আমরা কয়েক জন।
ওখানেই বসে বসে আলাপ হয়েছিল এক ফ্রেঞ্চ দম্পতির। দুই দেশের নানান সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের অনেক কথা হল। বয়স্ক ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক দুজনেই খুবই খোলামেলা ওনারা প্রায় এক বছর দুই ছাড়া ছাড়াই আসেন আর দক্ষিণে যতদিন থাকেন বিশেষ করে আলেপ্পিতে রোজই ওনারা সারা সকাল এই লাইট হাউসের ওপরে এসে বসে থাকেন।
লাইট হাউসের ওপরে আমরা অনেকটাই সময় কাটালাম। তারপর যখন দুপুরের দিকে লাইট হাউস বন্ধ হওয়ার সময় এল আমাদের নেমে যেতে বলতে আমরা নেমে গেলাম। একটু ফ্রেশ হলাম এবং খাওয়া-দাওয়া সারলাম বাইরের দোকানে। বিশেষ কিছু খাইনি বলতে গেলে ফ্রুট জুশ খেয়েই আমরা দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম। আসলে এতই রোদের প্রবাহ ছিল যে অন্য কিছু খাওয়ার মত ইচ্ছে একেবারেই হয়নি।
সেই সূর্য মাথায় নিয়েই আমরা রওনা হই আলেপ্পি বিচের দিকে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, বালি গরম হয়ে উঠেছে, হাওয়ায় লবণের ঝাঁঝ। বিচে পা রাখতেই বোঝা যায় রোদের তীব্রতা—বালিতে পা রাখা যায় না, চোখে সানগ্লাসের আড়াল থেকেও সূর্য ঢুকে পড়ে দৃষ্টিতে। কিন্তু সেই অসহনীয় গরমের মধ্যেও সমুদ্রের ঢেউ যেন ডাক দেয় বারবার। জল সবুজাভ নীল, আকাশ ফাঁকা, আর ঢেউ আসছে একের পর এক—চুপচাপ এসে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পাড়ে দাঁড়িয়ে রোদে সেঁকা গা নিয়ে তাকিয়ে থাকি সামনে—সমুদ্র, আকাশ আর আমি। মানুষজন আশেপাশে আছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ গলফ খেলছে বাচ্চার সঙ্গে, কেউ ছাতা খুলে বসে পড়েছে, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছিল একাকী দাঁড়িয়ে আছি এক বিশাল, জলরঙ আঁকা পটচিত্রের মাঝে।
আসলে এই রোদের মাঝে আর কাউকেই সাথে করে নিয়ে আসেনি ভেবেছিলাম হয়তো বসার জন্য স্যাক থাকবে। কিন্তু এখানে সেরকম কিছুই ছিল না শুধু মেলা বা কার্নিভাল হওয়ার জন্য কিছু রাইডস বা নাগরদোলা দেখতে পাই।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছিলাম আর বারবারই মনে হচ্ছিল প্রকৃতি কখনো একা থাকতে শেখায়, কখনো নিজেকে উপলব্ধি করতে শেখায়। আলেপ্পি আমাকে কিছু না বলে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেল। সেই সকাল, সেই আপ্পাম আর কফি, সেই ঘাম মাখা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, আর রোদের ঝলকানো দুপুরে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা—সব মিলিয়ে সেই দিন টা একেবারে ভরে গিয়েছিল। অপূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম হোটেলে।

পোস্টের ধরণ | ভ্রমণ ব্লগ |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | আইফোন ১৪ |
লোকেশন | |
অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিত গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1911122507459076191?t=IMnByZWPnA1Nc2wMOP16eQ&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911123960390942883?t=LrKraeJLheRTlHg85OQBvw&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911124794864795861?t=Jx0s4TJxd6IxccxQXOZppQ&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911125441991016750?t=3Aft-XCVwbhGyxyAEq-4Vg&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911125986709561683?t=JB_R9wXK7mbNjddZ3-foxw&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911126394697904446?t=7agCV-MbJD644d_iABZRSg&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911127148540068042?t=9dEmEi2RX95iv6FXQDZhvA&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911127750838288395?t=Iblf86oSXP-1AYyLGJeBfQ&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1911128206406517150?t=ndWzBex-o1KIyq0QmBEiYA&s=19