নতুন ভোরের স্বপ্ন: নববর্ষের নরম গল্পকথাগুলি
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
[সোর্স](Meta AI)


আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত!
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; নববর্ষে)
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিরই থাকে একটি নিজস্ব ঋতুচক্র, নিজস্ব ক্যালেন্ডার, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সময়ের চলার এক গভীর দর্শন। বাঙালির সেই সময়চক্রে নববর্ষ কেবল নতুন বছরের সূচনা নয়, এটি এক নরম আলোয় ধুয়ে দেওয়া আত্মপরিচয়ের আয়না। বৈশাখের প্রথম সকাল আমাদের নিয়ে যায় এক গহন অনুভবের জগতে—যেখানে আছে উৎসব, আছে প্রতীক্ষা, আর আছে না বলা কথার মতো মলিন বেদনা।
একটি ঋতুর দরজায় দাঁড়িয়ে
নববর্ষ আসে চৈত্রের রুক্ষতা পেরিয়ে। বলা হয় বসন্ত চলে যায় আর যেতে যেতে ফেলে যায় সকালের ফোটা ফুল, ফল, গাছ, নদী নালা পাহাড় পর্বত... বসন্ত চলে যায়, যেতে যেতে দিয়ে যায় বৈশাখের আনন্দ। নতুন বছর, নতুন দিন—
সে আসে ধূলিমাখা গ্রীষ্মের হাত ধরে, সঙ্গে করে আনে কাঁঠালের গন্ধ, কচি আমপাতার কাঁচা সবুজ, আর পাখিদের ব্যস্ততা। বসন্তের ফেলে যাওয়া কাল মাথায় আরও কত কিছুর সংযোজন। তাই না?
বৈশাখ আমাদের কাছে শুধুই গরমের প্রতীক নয়—এটি আসলে অপেক্ষার নাম, নতুন আশার নাম।
এই ঋতু বলে—পুরনো যা ছিল, তা ধুয়ে ফেলো, নতুন এক রোদের নিচে দাঁড়িয়ে দেখো নিজেকে আরেকবার।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
উৎসবের নাম বাঙালিয়ানা
নববর্ষে শহরজুড়ে গান বাজে, মানুষ রঙিন হয়, কিন্তু তারও মাঝে থাকে এক শান্ত, মৌন প্রার্থনা। বাঙালি নববর্ষ উদযাপন করে শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে। সাদা লাল রঙে ছেয়ে যায় প্রকৃতির আনাচকানাচ। চৈত্রসেলের সুবাদের এই দিনটিতে সকলেরই নতুন পোশাক পরার হিড়িক কিন্তু থাকেই। তাছাড়া হালখাতার কথা কিভাবেই বা ভুলে যাই। নতুন ক্যালেন্ডার, ঘরের কোণে বাসি ধূপের গন্ধে মেখে থাকা বিশ্বাস সব কিছু নিয়েই এই দিনটিতে মানুষ একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়—কিন্তু সেই শুভেচ্ছা যেন একান্ত, কোমল, মুখে মুখে নয়, হৃদয়ের গভীরে। এটি এক আত্মিক স্পর্শের দিন।
তবে আজকাল এতো কিছু হয় না৷ এই সবই যেন স্বপ্নের মতো শুনতে লাগে। আমরা যতই বলি পুরাতন গ্লানি মুছে নতুন শুরু করার কথা মনের মধ্যে কালো ঠিক থেকেই যায়৷
স্মৃতি ও আত্মস্মরণ
আমরা যতই বড় হই না কেন, নববর্ষ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছোটবেলার উঠোনে। যেখানে পাটপাটে জামা পরা বাবার হাত ধরে গিয়েছি দোকানের হালখাতায়, মা রান্না করেছেন নারকেল দেওয়া পায়েস, কচি পাঁঠার ঝোল। আর রেডিওতে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত। আমাদের যেহেতু নিজেদের শাড়ির দোকান রয়েছে তাই চৈত্র সেলের অসম্ভব খাটুনির বিশ্রাম পর্ব শুরু হত। সে কারণেই দোকানের সমস্ত কর্মচারীরা এই দিন আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করত। মামা মাসি পিসি সবাই আসতেন। বেশ বড়সড়োগ এলাহি ব্যাপার। বড় কড়াইতে করে দেশি মুরগির ঝোল কচি পাঁঠার ঝোল সাথে চিংড়ি মাছ কাতলা মাছ চাটনি দু তিন রকমের ভাজা ইত্যাদি তো থাকতোই। বাবা সবার জন্য বকশিশ হিসেবে হাড়ি ভর্তির রসগোল্লা, মাটির হাড়ি করে লাল দই, আর আনতেন কোল্ড ড্রিংক। সে সত্যিই এক উৎসব ছিল। সকাল সকাল মা লোহার ছেঁকা দিয়ে শুরু করতেন নববর্ষের দিন। তারপর পাঁচকুলের জল ছড়ানো। স্নান সেরে সবার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম। ব্যস আমাদের প্রাথমিক কাজ শেষ আর শুরু হত রান্নার কাজে হাত লাগানো। এই যেমন পেঁয়াজ রসুন ছাড়ানো ইত্যাদি।
এই দিনটি কেবল ‘আজ’ নয়, এটি ‘তখন’–এর মধ্য দিয়ে ‘এখন’-কে ছুঁয়ে যায়। আমাদের ইতিহাস, আমাদের শিকড়, আমাদের নিজস্বতা—সব যেন গুনগুনিয়ে ওঠে এই বৈশাখের হাওয়ায়। প্রতি বছরের স্মৃতি আজও টাটকা ছবি।
সমাজ ও সময়ের পাল্টে যাওয়া ছায়া
আমাদের নববর্ষ পাল্টে গেছে, যেমন পাল্টেছে আমাদের সমাজ। তবু কিছু কিছু চেতনা আজও টিকে আছে—গ্রামের হাটে, কোনো অবাঙালি বন্ধুর বাংলা গান গাওয়ার চেষ্টায়, শহরের অলিগলিতে রসগোল্লার নিঃশব্দ বিচরণ। নববর্ষ হয়তো এখন ডিজিটাল ক্যালেন্ডারে সীমাবদ্ধ, লোক।দেখানো সোসাল মিডিয়ার স্ট্যাটাস, ঘর সাজিয়ে নিজেকে ভাইরাল লরার প্রচেষ্টা আর সর্বপরি সুচারু মুখোশের মোড়কে নিজেকে ঢেকে দেওয়া। যেখানে আন্তরিকতার লেশ মাত্র নেই৷ কেবল প্রতিযোগিতা আছে, আছে সংকীর্ণতা। কিন্তু নববর্ষের আসল অর্থ আজও মুছে যায়নি। কোথাও না কোথাও ঠিকই আছে নিজের মতো, আপন ছন্দে আপন আনন্দে।
শেষ কথাগুলি
নববর্ষ একটি মনন, একটি অনুভূতি, এক অন্তর্জাগতিক আলোকধারা।
এটি উৎসব, কিন্তু অহমিকার নয়।
এটি আনন্দ, কিন্তু চিৎকারের নয়।
এটি স্মৃতি, কিন্তু জমে যাওয়া নয়।
নববর্ষ আমাদের বলে—নতুন করে ভাবো, নতুন করে ভালোবাসো, এবং নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলো।
আসুক বৈশাখ, আসুক আরও একবার।
আমরা যেন প্রতি নববর্ষে একটু বেশি মানুষ হতে পারি, একটু বেশি কোমল হতে পারি এই কামনা করে আজকের ব্লগ শেষ করছি।
বন্ধুরা, আপনাদের সব্বাইকে জানাই নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
কলমওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিত গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
https://x.com/neelamsama92551/status/1912171739225768206?t=rmwRqbVEUq9VWuSX0XCViw&s=19
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1912172798832697782?t=P9QhjgF3SgR8WXxC9uRD_g&s=19
https://x.com/neelamsama92551/status/1912173410509086999?t=Z5siBrTYnLW1rMy7Jei7bA&s=19
আপনি অনেক সুন্দর পোস্ট লিখেছেন। আপনার পোস্ট আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। এত সুন্দর পোস্ট লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আমার পোস্ট যে আপনার ভালো লেগেছে এবং আপনি ধৈর্য ধরে পুরোটা পড়লেন তার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন ভাইয়া আপনাকে শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।