গ্রীষ্মের সমুদ্র।
প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
গতকাল থেকে ছুটি বলেই একটু বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছি। আগেই বলেছিলাম৷ আজ পৌঁছেছি মালভান সী বিচে৷ দুপুরের তীব্র দাবদাহ। তার পরেও সমুদ্র তার নিজের মতন সুন্দর। বসে বসে দুপুরেই ভাবছিলাম এই কথা। আর হোটেল ঠিক করার ফাঁকে লিখে ফেলেছিলাম কিছু কথা। সেগুলোই আজ ব্লগে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
গ্রীষ্মকাল। সূর্য মাথার উপর ঝলসে ওঠে যেন রাগে ফেটে পড়া কোনো দেবতা। শহরের রাস্তাগুলি ফুটন্ত কড়াইয়ের মতো, ক্লান্তি চেপে ধরে জনজীবনকে। এই সময়েই হঠাৎ এক আকর্ষণ জাগে—সমুদ্র দেখার। যেন উত্তপ্ত হৃদয়ের একমাত্র আরাম, একমাত্র মুক্তি সেই নীল জলরাশি। গ্রীষ্মের সমুদ্র শুধু ঠাণ্ডা হাওয়ার প্রতিশ্রুতি নয়, সে এক রকম অনুভব—প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনের এক রহস্যময় আখ্যান।
সমুদ্র সারা বছরই তার নিজস্ব গম্ভীরতায় আবিষ্ট থাকে, কিন্তু গ্রীষ্মকালে তার চরিত্র যেন খানিক বদলে যায়। কিশোরী মেয়ের মতো সে হাসে, খেলে, ডাক দেয়—এসো, ভিজে যাও, ভুলে যাও। সেই ডাকেই আমরা ছুটে যাই দিঘা, পুরী, মন্দারমণি কিংবা কন্যাকুমারী। বুকভরা ক্লান্তি নিয়ে পৌঁছই জলের ধারে, আর এক ফোটা জলে ডুবেই যেন শরীর আর মনের ধোঁয়াশা মিলিয়ে যায়।
গ্রীষ্মের সমুদ্রের রঙ আলাদা। আকাশের রোদ যখন সমুদ্রের উপর পড়ে, তখন তার নীলচে রঙে একধরনের সোনালি ঝিলিক লাগে। দুপুরের রোদে জল এতটাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যে চোখে রোদচশমা না দিলে তাকানোই যায় না, তবু মন তাকিয়ে থাকে। সমুদ্রের ঢেউ যেন উন্মত্ত হয়ে উঠে একটার পর একটা গল্প বলে যায়—কারো প্রেমভঙ্গের, কারো হারিয়ে যাওয়া শৈশবের, আবার কারো নতুন করে জেগে ওঠার গল্প।
এই সময়টাতেই সমুদ্রতটে ভিড় বাড়ে। পর্যটকদের মুখে ক্লান্তির রেখা থাকলেও চোখে থাকে উত্তেজনার দীপ্তি। শিশুরা বালিতে দুর্গ বানায়, প্রেমিক-প্রেমিকারা হাত ধরে হাঁটে, বৃদ্ধরাও বসে থাকেন ভেজা বালুর উপর, জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে কিছুটা প্রশান্তির খোঁজে। সমুদ্র যেন সকলকে এক করে দেয়, ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ, সকলেই তার কাছে শুধুই একেকটা ক্ষণিকের যাত্রী।
গ্রীষ্মের সমুদ্র আমাদের সংস্কৃতিতেও বারবার ফিরে এসেছে। সাহিত্য, গান, সিনেমা—সবখানেই এই নীল বিস্তারের বিশেষ স্থান আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘সাগরিকা’, জীবনানন্দের সীমানাহীন স্বপ্ন, কিংবা সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’-র মত সিনেমায় সমুদ্র শুধুই ভৌগোলিক স্থান নয়, তা এক গভীর মানসিক চিহ্ন। গ্রীষ্মের সমুদ্র তাই শুধুই গরমের হাত থেকে পালানোর বাহানা নয়, বরং তা আমাদের আত্মার নির্জন দ্বীপ।
তবে সবকিছুর মাঝেই কিছু দুঃখজনক বাস্তবতাও রয়েছে। গ্রীষ্মকালীন ভিড়, বর্জ্য, বেপরোয়া পর্যটন—সমুদ্রের পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে। সমুদ্রের তটভূমি আবর্জনায় ঢেকে যায়, ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে আসে প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের মোড়ক। প্রকৃতির প্রতি আমাদের এই অবহেলা তার সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। গ্রীষ্মের এই উচ্ছ্বাসের মাঝে তাই দায়িত্বশীলতার বোধ জাগানো জরুরি।
গ্রীষ্মের সমুদ্র একান্তভাবে অনুভবের। যারা ভালোবেসে তাকে দেখে, তারা জানে এই সমুদ্র কেবল ঠান্ডা হওয়ার জায়গা নয়, বরং মন শান্ত করার জায়গা। ঢেউয়ের ছন্দে একধরনের ধ্যান আছে, বালুর উপর পা ফেলার মাঝে একধরনের মুক্তি আছে, আর সূর্যাস্তের সময় আকাশ ও জলের রঙে এক অপার্থিব সুর। এইসব মিলিয়ে গ্রীষ্মের সমুদ্র হয়ে ওঠে আমাদের অভ্যন্তরের একটা মানচিত্র—যেখানে আমরা হারিয়ে যেতে চাই, আবার খুঁজে পেতে চাই নিজেকেই।
সমুদ্রের কাছে গেলে বোঝা যায়—জীবন আসলে ঠিক কতটা ক্ষণিক, কতটা প্রবাহমান। গ্রীষ্মে যখন সমুদ্রের দিকে তাকাই, তখন যেন ভিতর থেকে এক অজানা শক্তি ফিরে আসে। মনে হয়, যতটা ক্লান্তি, ততটাই সম্ভব রিফ্রেশ হওয়ার। ঠিক যেমন প্রকৃতি বারবার নিজেকে নবীন করে, আমরাও পারি। গ্রীষ্মের এই বিস্তৃত জলরাশি আমাদের শেখায়—ভালোবাসা যেমন গভীর হতে পারে, তেমনই হতে পারে মুক্ত; জীবন যেমন জটিল, তেমনই সহজ।
তাই বলি, গ্রীষ্মের সমুদ্র আমাদের জীবনের এক অনিবার্য অভিজ্ঞতা। সে শুধু ভ্রমণ নয়, আত্মদর্শনের একটি সুযোগ। যখন সূর্য প্রখর, তখনই তো সবচেয়ে প্রয়োজন হয় ছায়ার—আর সমুদ্র, সেই প্রখর দিনে, হয়ে ওঠে আমাদের নীল ছায়া।

পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
কলমওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | স্যামসাং এফ৫৪ |
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিত গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
https://x.com/neelamsama92551/status/1913630711912743014?t=IQkVJAQFHllWw_2BRyy0PA&s=19
আমার সমুদ্র দেখার সৌভাগ্য এখন পযর্ন্ত হয়নি। গ্রীষ্মকালে যে সমুদ্র তার রুপ পরিবর্তন করে এটা জানতাম না। জেনে বেশ ভালো লাগল। বেশ সুন্দর গুছিয়ে লিখেছেন আপু। ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের সাথে শেয়ার করে নেওয়ার জন্য।।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সুন্দর করে মন্তব্য করলেন আর ব্লগটা পড়লেন তাই। ভালো থাকবেন৷